চট্টগ্রাম: পিতা মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর পদাংক অনুসরণ করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল চট্টগ্রামের রাউজানের সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। শুধু বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হয়নি।
স্বাধীনতার বিরোধিতা করেও এই রাজাকারই স্বাধীন দেশে একদিন মন্ত্রী-এমপি হয়েছিল। তার গাড়িতে উঠেছিল রক্তে কেনা লাল-সবুজের পতাকা। ক্ষমতার দম্ভে মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা ছিল সাকা’র চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। স্বাধীনতার বিরোধিতার কথাও প্রকাশ্যে দম্ভভরে বলত সাকা। তবে তার সব অহংকার-দম্ভের পতন হয়েছে। একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে চলতি বছরের ২১ নভেম্বর সাকা’র ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
সাকা’র ফাঁসি ২০১৫ সালে বিপ্লবীদের পূণ্যভূমি চট্টগ্রামের জন্য ঐতিহাসিক একটি ঘটনা। এ ফাঁসি ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে। তাদের মতে, এক ফাঁসিতে চট্টগ্রাম কলংকমুক্ত হয়েছে। চট্টগ্রামের মাটি পুতপবিত্র হয়েছে সাকা’র ফাঁসিতে। চট্টগ্রামকে আর ‘রাজাকার-কুলাঙ্গারের এলাকার’ অপবাদ বয়ে বেড়াতে হচ্ছেনা।
শহীদ জায়া বেগম মুশতারি শফি বাংলানিউজকে বলেন, অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত বিচারে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি হয়েছে। আমরা যারা একাত্তরে স্বজন হারিয়েছি তারা এই ফাঁসিতে স্বস্ত্বি পেয়েছি। চট্টগ্রামের মানুষ স্বস্ত্বি পেয়েছে। কিন্তু সালাহউদ্দিন কাদেরের লাশটা চট্টগ্রামের মাটিতে দাফন করতে দেয়া উচিৎ হয়নি। তার লাশ পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া অথবা সাগরে ভাসিয়ে দেয়া দরকার ছিল। তারপরও বলব সালাহউদ্দিন কাদেরের মত একজন কুখ্যাত লোকের ফাঁসিতে চট্টগ্রাম কলংকমুক্ত হয়েছে, বাংলাদেশ কলংকমুক্ত হয়েছে।
২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সাকা চৌধুরীকে ফাঁসির রায় দেন ট্রাইব্যুনাল-১। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ রায় দেন।
২৯ জুলাই ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে সাকা চৌধুরীর আপিল মামলার সংক্ষিপ্তাকারে চূড়ান্ত রায় দেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ এ রায় দেন। অন্য বিচারপতিরা হচ্ছেন, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
১৮ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদন খারিজ করে ফাঁসির রায় বহাল রাখেন। ২১ নভেম্বর ফাঁসি কার্যকর হয়ে পরদিন রাউজানের গহিরায় নিজ বাড়িতে কুখ্যাত এই যুদ্ধাপরাধীর দাফন হয়।
সাকা চৌধুরীকে যে চার হত্যা-গণহত্যার দায়ে ফাঁসির কাষ্ঠে যেতে হয়েছে, সেগুলো হল- কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সমাজসেবক-দানবীর অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে তিনজনকে গণহত্যা, রাউজানের ঊনসত্তরপাড়ায় ৫০-৫৫ জনকে গণহত্যা এবং চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহম্মদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে হত্যা।
সাকা’র বর্বরতায় অতিষ্ঠ হয়ে ১৯৭১ সালে তাকে গ্রেনেড ছুঁড়ে হত্যার চেষ্টা করেছিল মুক্তিযোদ্ধারা। প্রাণে বেঁচে গিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল সাকা। স্বাধীনতার তিন বছর পর দেশে ফিরে আসে।
সালাহউদ্দিন কাদেরের দেশে ফেরার বর্ণনা গত ২৩ নভেম্বর এক সমাবেশে অর্থনীতিবিদ ড. মঈনুল ইসলাম দিয়েছেন এভাবে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর ক্ষমার সুযোগ নিয়ে দেশে আসে। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তার পা ধরে হাউমাউ করে কাঁদে। বঙ্গবন্ধু তার বন্ধুর ছেলেকে টেনে নিয়েছিলেন। সেটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর বড় ভুল। কিউসি শিপিং ছিল পরিত্যক্ত সম্পত্তি। বঙ্গবন্ধু সেটা বন্ধুর ছেলের নামে লিখে দিয়েছিলেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগ পর্যন্ত মুসলিম লীগ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিল। জিয়াউর রহমানের আমলে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলে মুসলিম লীগ আবারও রাজনীতি শুরু করে। সালাহউদ্দিন কাদের ১৯৭৯ সালে মুসলিম লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। এরপর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সাকা মুসলিম লীগ, জাতীয় পার্টি, এনডিপি ও বিএনপি থেকে মোট আটবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। এরশাদ তাকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। আর বেগম খালেদা জিয়া তাকে মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন।
মন্ত্রী-এমপি থাকার সময় রাউজানে সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী গড়ে তুলেছিল সাকা। সংখ্যালঘুরা ছিল সাকা’র ভয়ে তটস্থ। সাকা’র আমলে যে কোন নির্বাচনের সময় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া ছিল রাউজানের অঘোষিত রীতি। সেখানে আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির রাজনৈতিক কার্যক্রম ছিল প্রায় নিষিদ্ধ। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে অশ্লীল শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিনিয়ত কটাক্ষ করত সাকা। রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের বিশেষ করে আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সংগঠকদের চরিত্র হননে সিদ্ধহস্ত ছিল সাকা। গণমাধ্যমে এজন্য বারবার নেতিবাচক শিরোনাম হয়ে এসেছে সাকা।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। ২০১০ সালের ১৫ ডিসেম্বর সাকা ঢাকার একটি ফ্ল্যাট থেকে আত্মগোপনরত অবস্থায় গ্রেফতার হয়। আওয়ামী লীগ যখন মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করে তখন স্বভাবসুলভ সাকা অনেক হম্বিতম্বি করেছিল। তাকে গ্রেফতার করলে ফেনী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত স্বাধীন হয়ে যাবে-এমন বালখিল্য কথাবার্তাও বলেছিল। কিন্তু গ্রেফতারের পর সাকা’র সব বুলি অসাড় প্রমাণিত হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে যারা সাক্ষ্য দিতে গিয়েছিলেন তাদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখানো থেকে শুরু করে কটাক্ষ করা হয়েছিল। এমনকি রায় ঘোষণার সময় ট্রাইব্যুনালের বিচারকদেরও অশ্লীল কটুক্তি করেছিল।
তবে ইতিহাসের বিচারে শেষ পর্যন্ত সাকা’র দর্পচূর্ণ হয়েছে। তাকে গ্রেফতার থেকে শুরু করে ফাঁসি পর্যন্ত হয়ে গেলেও কেউ তার পক্ষে মাঠে নামেনি। সাকা’র সব বুলি, তর্জন-গর্জন যে আসলেই ফাঁকা তা প্রমাণ হয়েছে বিচার শুরুর পর। শেষ পর্যন্ত ফাঁসিকাষ্ঠে গিয়েই নিজের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে সাকাকে।
গণজাগরণ মঞ্চ, চট্টগ্রামের সমন্বয়কারী শরীফ চৌহান বাংলানিউজকে বলেন, সালাহউদ্দিন কাদের একজন গণহত্যাকারী রাজাকারই শুধু নয়, সে একজন নষ্ট রাজনীতির জন্মদাতা। একবার বিচার এড়াতে পেরে মন্ত্রী-এমপি হয়ে সে ভেবেছিল তার পাপের বিচার আর হবেনা। এজন্য সে ধরাকে সরাজ্ঞান করত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাকা’র পতন হয়েছে। বাংলাদেশ জিতেছে। চট্টগ্রাম কলংকমুক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৫
আরডিজি/আইএসএ/টিসি