চলতি বছরের ৩ সেপ্টেম্বর একাত্তরের আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রামের কমান্ডার মীর কাসেম আলীর ফাঁসির মধ্য দিয়ে কলঙ্কমুক্ত হয় চট্টগ্রাম। একইসঙ্গে দীর্ঘদিনের চাপা আতংক থেকে মুক্তি পায় সেই ডালিম হোটেলের (মহামায়া ভবন) বাসিন্দারা।
একাত্তরে মীর কাসেম আলীর নির্দেশে চট্টগ্রাম শহরের টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্রী চন্দ্রমোহন নাথ ওরফে রঞ্জন নাথের মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেওয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনী চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির।
ডালিম হোটেলের দোতলায় ডান পাশের বাসাটিতে টর্চার সেল গড়ে সেখানে নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করা হয়। একাত্তরে ডালিম হোটেলে আলবদর বাহিনীর নির্যাতনের শিকার এবং স্বজন হারানোরা এখনও সেখানে শুনতে পান নিরীহ বাঙালির করুণ আর্তনাদ, চাপা কান্না। এখনও ডালিম হোটেলের সামনে গেলে শিউরে উঠেন নির্যাতিতরা।
তাই ৩ সেপ্টেম্বর রাতে মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পরপরই বাঁধভাঙা আনন্দে ভেসে পড়েন চট্টগ্রামবাসী। আনন্দ মিছিল, স্লোগান, মিষ্টি বিতরণের মধ্য দিয়ে সেই মাহেন্দ্রক্ষণটিকে স্মরণীয় করে রাখেন তারা।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় চট্টগ্রাম জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো.সাহাব উদ্দিন বলেছিলেন, কুখ্যাত এ রাজাকারের ফাঁসি কার্যকরে সারাদেশের মানুষ আনন্দিত। কিন্তু চট্টগ্রামের মানুষ সবচেয়ে বেশি আনন্দিত। কারণ এর আগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওরফে সাকার ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল। মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে দুই রাজাকারের সর্বোচ্চ শাস্তি হলো। আর এই দুই রাজাকারের ফাঁসির মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম কলঙ্কমুক্ত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকালে আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রামের সদর দপ্তর ডালিম হোটেলকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি যাদুঘর বানানোর দাবি জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, ডালিম হোটেলকে মীল কাসেম জল্লাদখানায় পরিনত করেছিল। এই ডালিম হোটেলকে অধিগ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের যাদুঘর করা হোক।
শহীদ জায়া বেগম মুশতারি শফি বলেছিলেন, এই রাজাকারের উপযুক্ত শাস্তি হওয়ায় অত্যন্ত খুশি হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদর-শামস বাহিনী গঠন করে মীর কাসেম আলী যে অত্যাচার চালিয়েছে এর কোন ক্ষমা নেই।
মীর কাসেমের ফাঁসিতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেছিলেন, ‘তার ফাঁসি হওয়া দেখতে পেরে একজন চট্টগ্রামবাসী হিসেবে আমি আজ গর্বিত। ’
মীর কাসেমের নির্মমতা নিয়ে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়া মৃদুল দে বলেছিলেন, ‘মীর কাসেমের ফাঁসি হয়েছে, তাতেই খুশি। একাত্তরে যারা ডালিম হোটেলে মীর কাসেমের বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছিল তারা সবাই শান্তি পেয়েছে। ডালিম হোটেলে শহীদদের আত্মা শান্তি পেয়েছে। ’
ডালিম হোটেলে নির্যাতনের শিকার মো.জাহাঙ্গীর চৌধুরী বলেছিলেন, ডালিম হোটেলের সামনে গেলে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। আমাদের যে কিভাবে নির্যাতন করেছে, ভুলতে পারব না। ৪৬ বছর ধরে ডালিম হোটেলের কলঙ্ক বয়ে বেড়িয়েছে এই মহামায়া ভবন। সেই কলঙ্কের অবসান হয়েছে, তবে যতদিন বাঙালি জাতি থাকবে ততদিন ডালিম হোটেল মীর কাসেমদের নির্যাতনের সাক্ষ্য বয়ে বেড়াবে।
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলে দৈনিক নয়াদিগন্ত কার্যালয় থেকে মীর কাসেমকে গ্রেফতার করা হয়। পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার যুদ্ধাপরাধের বিচার।
২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমসহ মোট আটজনকে হত্যার দায়ে মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ এসেছিল। ২০১৬ সালের ৮ মার্চ আপিল বিভাগ জসিমকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। এছাড়া আরও বিভিন্ন অভিযোগে পৃথকভাবে মোট ৫৮ বছরের কারাদণ্ড দেয়।
এরপর মীর কাসেম আলী আপিল বিভাগে মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। গত ৩০ আগস্ট প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ মীর কাসেম আলীর চূড়ান্ত রায় পুর্নবিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার আদেশ দেন।
এরপর ৩ সেপ্টেম্বর রাতে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর ফাঁসির মঞ্চে এই জল্লাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৬
আইএসএ/টিসি