ঢাকা, রবিবার, ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২৬ মে ২০২৪, ১৭ জিলকদ ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

পেনড্রাইভে নথি পাচার, দায় এড়াতে তৎপর শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান 

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪০ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০২২
পেনড্রাইভে নথি পাচার, দায় এড়াতে তৎপর শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান  ...

চট্টগ্রাম: শিক্ষা বোর্ডের সচিব প্রফেসর আবদুল আলীম বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন। কর্তব্যে অবহেলা, তদবিরে একাধিকবার ঢাকা ভ্রমণ, কর্মচারীদের স্বেচ্ছাচারিতা, সর্বশেষ বোর্ডের ফলাফল সংক্রান্ত গোপন নথিপত্র পেনড্রাইভে করে বাইরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

 

শিক্ষা বোর্ডের গঠিত তদন্ত কমিটি গত ২২ ফেব্রুয়ারি ফলাফলের সিডি চেয়ে আবেদন করে। ওই আবেদনে চেয়ারম্যানের রুটিন দায়িত্বে থাকা প্রফেসর আবদুল আলীম স্বাক্ষর করে  ফলাফলের গোপন দলিল পেনড্রাইভে দিতে নির্দেশ দেন।

এ সংক্রান্ত সংবাদ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হলে বোর্ড চেয়ারম্যান নড়েচড়ে বসেন। কিন্তু এখন নিজ দায় এড়াতে তৎপর হয়েছেন। তিনি নিজে নির্দেশ দিয়ে নিজে ব্যাখ্যা তলবের জন্য গতকাল ২ মার্চ সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্টকে পত্র দিয়েছেন।  

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড থেকে সম্প্রতি পেনড্রাইভে করে ফলাফল বাইরে ‘নিয়ে-যাওয়ার’ বিষয়টি সামনে এসেছে। বড় ধরনের এ অনিয়মের ঘটনার জন্য দায়ী করা হচ্ছে বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা সচিব অধ্যাপক আবদুল আলীমকে। তার অনুমতিতেই এ ফলাফল বাইরে গেছে। এ নিয়ে শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ফলাফলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে চলছে নানা সমালোচনা। স্থবির হয়ে পড়েছে বোর্ডের নানা কার্যক্রম।

জানা গেছে, পাবলিক পরীক্ষার লাখো শিক্ষার্থীর ফলাফল সংক্রান্ত যাবতীয় ডাটা (তথ্য) শিক্ষাবোর্ডের পাশাপাশি এবং ফল প্রকাশে বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান টেলিটক ও বুয়েটের কাছেই সংরক্ষিত থাকে। প্রতিটি শিক্ষাবোর্ড নিজেদের ফলাফল সার্ভারে সংরক্ষণ করে। প্রয়োজনে আন্তঃবোর্ড এসব ডাটা ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের এ সব নিয়ম-নীতির কোনো ধরনের তোয়াক্কা না করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড চট্টগ্রামের এইচএসসি ২০২১ পরীক্ষার ফল সার্ভার থেকে পেনড্রাইভে করে বোর্ডের গঠিত একটি তদন্ত কমিটির সদস্যরা বাইরে নিয়ে গেছেন। এতে করে বোর্ডের শিক্ষার্থীদের গোপনীয় তথ্য সংরক্ষণে বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।

চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান (বর্তমান সচিব) অধ্যাপক আবদুল আলীম বাংলানিউজকে বলেন, যেহেতু বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। সেহেতু একটা তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে আমি কথা বলতে পারবো না। যদি এ বিষয়ে কারো কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে বোর্ডে যোগাযোগ করলে আমরা দেখবো।

গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড চট্টগ্রামের উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা (এইচএসসি) ২০২১ ফলাফল প্রকাশের পর চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের ওয়েবসাইটে পরীক্ষার্থীদের প্রাপ্তনম্বর প্রদর্শনে অসঙ্গতির বিষয়ে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বোর্ড থেকে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক চট্টগ্রামের পটিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, অপর দুই সদস্য হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এএইচএম সাজেদুল হক ও চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সহকারী সচিব সম্পাতা তালুকদার। ৭ কর্মদিবসের মধ্যে বিষয়টি তদন্ত করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বরাবরে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তবে ইতোমধ্যে ১১ কর্মদিবস অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও ওই তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়নি।  

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে পরীক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নম্বরের অসঙ্গতির বিষয়ে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির আহ্বায়কের বিরুদ্ধে জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। দীর্ঘ ৩ দশক পর শিবিরের আধিপত্য বিস্তার থেকে ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর সরকারি চট্টগ্রাম কলেজ ও হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ মুক্ত করে তৎকালীন আন্দোলনরত ছাত্রলীগ। চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুল হক বলেন, ছাত্রলীগ ওই সময় ৮ শিক্ষকসহ মোট ১১ শিক্ষক-কর্মচারী নাম প্রকাশ করে। যাদের জামায়াত শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে। এর মধ্যে সম্প্রতি বোর্ড থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়কের নাম রয়েছে। তিনি যখন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে পটিয়া কলেজের অধ্যক্ষ হন তখন আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। এই শিক্ষক থাকেন নগরের প্যারেড মাঠের পাশে জামায়াতের অর্থের জোগানদাতা হিসেবে চিহ্নিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়া জামায়াত শীর্ষ নেতা মীর কাশেম আলীর মালিকানাধীন কেয়ারি ইলিশিয়ামে।

এছাড়া ওই তদন্ত কমিটির দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন চবি সহকারী অধ্যাপক এএইচএম সাজেদুল হক। যিনি জামায়াত ঘরানার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক মহিউদ্দিন চৌধুরীর জামাতা। বছরখানেক আগে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে অপসারিত হন। এতে প্রশ্ন উঠেছে, নম্বর অসঙ্গতির বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটিতে জামায়াত শিবির সমর্থিতদের রাখা নিয়ে।

তদন্ত কমিটির দুই সদস্যের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। গত ২ মার্চ বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে এ আবেদন করেন তিনি।

চিঠি বলা হয়, গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যদের রাজনৈতিক পরিচয়ের ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তদন্ত কমিটির আহবায়ক সম্পর্কে banglanews24.com অনলাইন পোর্টালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি মাহমুদুল করিমের বরাত দিয়ে একটি মন্তব্য প্রচার হয়েছে। তাতে আহ্বায়কের রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরেন ওই ছাত্রনেতা। আহ্বায়ক স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উপরন্তু, তদন্ত চলাকালে তারা অত্র বোর্ডের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে দীর্ঘসময় আলাপ-আলোচনায় লিপ্ত ছিলেন। এ ছাড়া তদন্ত কমিটির ১ নম্বর সদস্য এএইচএম সাজেদুল হকের শ্বশুর প্রফেসর গোলাম মহিউদ্দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জামায়াত-বিএনপি সমর্থিত সাদা প্যানেলের আহ্বায়ক ছিলেন। পরে গোলাম মহিউদ্দিন আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন, যেটা জামায়াতের অনুদানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। গোলাম মহিউদ্দিনের জামাতা হিসেবে এএইচএম সাজেদুল হকের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। এতে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও ১ নম্বর সদস্যের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে এ তদন্ত কমিটি করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এছাড়াও তদন্ত চলাকালে তদন্তের নামে এইচএসসি ২০২১-এর ফলাফলের ডাটা পেনড্রাইভে করে আপনার বরাত দিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়ায় বোর্ডের গোপনীয় তথ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে, যা জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। এমতাবস্থায় আশঙ্কা করছি যে,  তদন্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা হচ্ছে, যার সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্র সরাসরি সম্পৃক্ত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অতএব, বিষয়টি সদয় বিবেচনাপূর্বক তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসর মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ও ১ নম্বর সদস্য এএইচএম সাজেদুল হককে পরিবর্তন করে নিরপেক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি দিয়ে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আপনার প্রতি বিনীত আবেদন জানাচ্ছি। এতে তদন্তে সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে আমি মনে করি।

চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান (বর্তমান সচিব) অধ্যাপক আবদুল আলীম বাংলানিউজকে বলেন, গোপনীয় কোনো বিষয়ে আমার স্বাক্ষরিত চিঠি বা অনুমতিপত্র দেয়নি। আর বিভিন্ন গণমাধ্যমে যেটি গোপনীয় তথ্য বলছে সেটি হলো ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল। এছাড়াও পেনড্রাইভে করে যে তথ্য বাইরে গেছে বলা হচ্ছে সেটি বাইরে যায়নি বোর্ডের অভ্যন্তরেই ছিল। ফলাফল সিডিতেই সংরক্ষিত থাকে, সিডি না থাকায় পেনড্রাইভে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আমি সিস্টেম এনালিস্ট এবং তদন্ত কমিটির সদস্যের জিজ্ঞেস করেছি। তারা বলেছেন, পেনড্রাইভে করে কোনো গোপন তথ্য বাইরে নেননি। শুধু তদন্তের স্বার্থে ২০২১ সালের এইচএসসির ফলাফল আর ওই রুমের ভিডিও ফুটেজ নিয়েছেন।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক বাংলানিউজকে বলেন, আমরা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি। বিষয়টি আমরা দেখছি।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০২২ 
বিই/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।