ঢাকা: বিদায়ী বছরজুড়ে ডলারের বাজার অস্থির ছিল। বছর শেষে ডলারের প্রধান জোগান রেমিট্যান্স প্রবাহে টান পরিস্থিতিকে নাজুক করে দেয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্বিক মূল্য পরিস্থিতি অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়। যুদ্ধের আগের একই পণ্য যুদ্ধের দুই মাসের মাথায় আমদানি করতে ব্যয় বেড়ে যায় ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত। যা প্রবাসী আয়, রপ্তানি আয় ও বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে আসা ডলারে যোগান দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। সঙ্গে কমতে থাকে প্রবাসী আয়। দেশের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি জীবনযাত্রাকে অসহনীয় করে তোলে। বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন (রিজার্ভ) ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। এতে হিতে বিপরীত হয়। বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন নামে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে, যা কয়েক মাস আগেও ৪৮ বিলিলন ডলার ছিল।
এ সময় বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। নাভিশ্বাস ওঠে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের। স্মরণকালের মূল্যস্ফীতির ঘটনা ঘটে। অতিক্রম করে যায় ৯ শতাংশ। নিত্যপণ্যের বাজারকে অস্থির করে তোলে কালোবাজারি ও মজুতদাররা। আর হুন্ডি ও পাচারকারীদের কারণে উত্তপ্ত হয় আর্থিক বাজার।
পরিস্থিতি সামাল দিতে এ সময় অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল পণ্য আমদানিতে লাগাম টানে বাংলাদেশ ব্যাংক। শুরু হয় পণ্য আমদানিতে খোলা এলসির পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা এবং প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে নানামুখী উদ্যোগ। একই সঙ্গে চলতে থাকে ডলারের কারসাজি রোধে সমন্বিত উদ্যোগ। কিছু উন্নতি হলেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি ডলারের বাজার। এ সময় পাঁচ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল ও প্রায় অর্ধ শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এরই মধ্যে শুরু হচ্ছে নতুন বছর। পরিস্থিতির উন্নতি নতুন বছরে অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, পরিস্থিতির উত্তরণে যে সব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি আস্তে আস্তে উন্নতি হচ্ছে। নতুন বছরে মাঝামাঝির আগেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। তবে সতর্ক প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. আতিউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যে সব উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলোর সফল বাস্তবায়ন দরকার। তাহলে এই জায়গাগুলো আরও সহজ হবে।
তিনি আরও বলেন, ডলার একক রেটে আমরা এখনো নিয়ে আসতে পারিনি। আমদানিকারক ও রেমিটারদের আলাদা রেট থাকার কারণে একটি কনফিউশন তৈরি হয়। যে সব কারণে হুন্ডি হয়, সেই কারণগুলো দূর করতে হবে। ব্যাংকি খাত আরও স্বচ্ছতার সাথে পরিচালনা করলে হুন্ডির সুযোগগুলো কমে আসবে।
আতিউর রহমান বলেন, কালো টাকা হলেই হুন্ডি হয়। এই সুযোগগুলো কমিয়ে ফেলতে হবে। যাতে হন্ডি না হয় এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে সহজে প্রবাসীরা টাকা পাঠাতে পারেন সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদেশ থেকে যাতে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে পারে; বিশেষ করে ট্রেজারি বন্ড সহ বিভিন্ন ধরনের যেসব বন্ড আছে সেগুলোতে বিনিয়োগ করতে পারে সেই সুযোগ বাড়াতে হবে।
মূল কথা যে সব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেগুলো আরও ভালোভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার। যে কাজগুলো আমরা করছি, সেগুলো ঠিকমতো করছি কিনা, সেগুলো গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে, যোগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।
পরিস্থিতি উত্তরণে যে উন্নতি হয়েছে সেগুলো ধরে রাখার পাশাপাশি সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে আরও সমন্বয় বাড়ানোর ওপর তাগিদ দেন তিনি।
যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে দেশে দেশে অর্থনীতিতে সংকট তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও চাপ তৈরি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, বণ্টন পরিস্থিতি সচল থাকার কারণে সামাল দেওয়া যাচ্ছে। অভ্যন্তরীল বণ্টন পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতো বলে মনে করেন ড. আতিউর রহমান।
অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে আরও জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির ৭০ ভাগই অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত। এগুলোতে আরও জোর দিতে হবে। আমরা জাতীয় অর্থনীতির ওপর জোর দিচ্ছি। নতুন বছরে আমাদের কৃষি খাত, উৎপাদন খাত, এসএমই—এসব খাতের ওপর জোর দিতে হবে।
বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে দেশে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছিল, এ সংকট কেটেও যাচ্ছে। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমে আসা আর ডলারের তেজ কমে আসার কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। কিন্তু তার আগে পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজন ও চাহিদা মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ কাজে আসে বলে মনে করেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, প্রধান সমস্যাই ছিল ডলার সংকট। এই সমস্যা থেকেই বাকি সমস্যাগুলো হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে স্থিতিশীল অবস্থা, অভ্যন্তরীণভাবে দর একটি স্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে আছে। সংকটের যে অবস্থা ছিল ইতোমধ্যে কেটে গেছে। রপ্তানি আয় এখনো বাড়ছে। রেমিট্যান্স বাড়লে বাকি সমস্যাও থাকবে না।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার যেভাবে ঊর্ধ্বমুখী ছিল এখন সেটা নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল আছে, ডলারমূল্য পরিস্থিতিও আর উঠছে না। ডলারের দামে একটা সময় বড় ধরনে পার্থক্য ছিল, আস্তে আস্তে মার্কেট রেটের কাছাকাছি আনা হয়েছে। এর ফলে বাজারে যে ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি হচ্ছিল, সেগুলোর সুযোগ কমে গেছে।
পরিস্থিতির উন্নতি হলেও নতুন বছর নিয়ে সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক। তিনি বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির যদি উন্নতি হয়, যদি সব কিছু ঠিক থাকে তাহলে আমাদেরও সব ঠিক থাকবে। যদি ঠিক নাও হয় তাহলেও আমরা উদ্যোগ নেবো। যদি পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যায় তাহলে দেশের অর্থনীতি আবার ঠিক হয়ে যাবে। যুদ্ধাবস্থা যদি চলতে তাকে, তাহলে অবস্থা বুঝেই বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নেবে।
তিনি বলেন, প্রবাসীরা যাতে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠায়, এ জন্য ব্যাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিভিন্ন রকম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে কিছুটা ইতিবাচক ফল মিলছেও। এছাড়া সামনে ঈদ। সে কারণেও প্রবাসীরা বেশি বেশি টেমিট্যান্স পাঠাবে, এ সব কারণে রেমিট্যান্স বাড়বে বলে আমরা আশা করছি। এবার বেশি সংখ্যক শ্রমিক বিদেশে গেছে। তারা রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।
তবে কালো মেঘ একেবারে কেটে যায়নি, কিছুটা এখনো রয়েই গেছে। কেউ কেউ নতুন বছরে মন্দার কথা বলছেন। এর প্রভাব কিছুটা হয়তো থাকতে পারে। আমরা আশা করছি রেমিট্যান্স আস্তে আস্তে আগের জায়গায় ফিরে যাবে, বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এই মুখপাত্র।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে ফি মওকুফসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটাও রেমিট্যান্সে প্রভাব ফেলবে। মোবাইল ফাইনান্সিং ব্যবহার করে রেমিট্যান্স পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় প্রডাক্ট রেডি করে লঞ্চিংয়ে যেতে আরও খানিক সময় লাগবে। নতুন রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে এটাও ভূমিকা রাখবে। বৈদেশিক মুদ্রা বাজারকে স্থিতিশীল করবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০২৩
জেডএ/এমজেএফ