ঢাকা, রবিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ: কৃষকেরা খুশি, অস্বস্তিতে ক্রেতারা

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৬ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০২৩
পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ: কৃষকেরা খুশি, অস্বস্তিতে ক্রেতারা

ঢাকা: আর মাত্র এক সপ্তাহ পরেই রমজান মাস। কিন্তু তার আগেই ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে অনুমতি (আইপি) বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

এরই মধ্যে বাজারে সংকট না থাকলেও চাহিদা বাড়ায় বেশির ভাগ পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে।

এদিকে চাষিরা যেন তাদের উৎপাদিত পেঁয়াজের ন্যায্যমূল্য পায়, তা নিশ্চিত করতে বৃহস্পতিবার (১৬ মার্চ) থেকে বন্ধ হয়েছে পেঁয়াজ আমদানি। এই সিদ্ধান্তে কৃষকেরা খুশি হলেও ক্রেতা-ভোক্তারা অস্বস্তিতে আছেন। অনেকে মনে করছেন, এর ফলে রমজানকে সামনে রেখে সিন্ডিকেটের হাত ধরে দেশে পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। ইতোমধ্যে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধে কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা দাম বেড়েছে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর শ্যামবাজার, রায়সাহেব বাজার, সুত্রাপুর, ধূপখোলা মাঠ বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে দেখা গেছে, পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি দেশি হালি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩২ থেকে ৩৫ টাকা কেজি, যা একদিন আগেও ৩০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। আর মুড়িকাটা দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি মানভেদে ২৮ থেকে ৩০ টাকা, যা একদিন আগেও বিক্রি হতো ২৬ থেকে ২৮ টাকা কেজি। আর আমদানি করা ভারতের পেঁয়াজ ৩০ থেকে ৩২ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ২৮ থেকে ৩২ টাকা। সে হিসেবে প্রতি কেজিতে দেশি ও আমদানি করা পেঁয়াজের দাম সপ্তাহ ব্যবধানে বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা।

খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি হালি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৫ টাকা আর মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৬ টাকায়, যা একদিন আগে ছিল মুড়িকাটা ৩২ টাকা, আর হালি পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৪২ টাকা। আর আমদানিকৃত ভারতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে, যা একদিন আগে বিক্রি হয়েছিল ৩৫ থেকে ৩৮ টাকায়। সাধারণত দেশি পেঁয়াজের দামের তুলনায় আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজিতে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ টাকা কম না হলে ভোক্তারা ভারতীয় পেঁয়াজ কিনতে চান না।

সুত্রাপুর বাজারের ক্রেতা সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে পেঁয়াজের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। তবে আমদানি বন্ধের খবরে আজকে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে। এটা হতে পারে না। বাজারে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ রয়েছে, ভরা মৌসুম। কোনো সংকট নেই। প্রতিবারের মতো রমজানের সময় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দেয়, তাই সরকারের বাজার তদারকি জোরদার রাখতে হবে।

পেঁয়াজের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে দেশীয় পেঁয়াজের ভালো সরবরাহ থাকায় আমদানিকৃত পেঁয়াজের চাহিদা কিছুটা কম। এতে চাহিদার তুলনায় আমদানি বাড়ায় দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম কমতির দিকে ছিল। কিন্তু আজ থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ হওয়ায়, হঠাৎ করে বাজারে পেঁয়াজের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমায় আমদানিকৃত ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কিছুটা বাড়ছে। সেই সঙ্গে দেশীয় পেঁয়াজের দাম খানিকটা বাড়ছে।

এছাড়া বর্তমানে দেশের বাজারে দেশীয় পেঁয়াজের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। ভারতের পেঁয়াজ আমদানিতে লোকসানের সম্ভাবনা দেখছেন আমদানিকরাকরা। সে কারণেই আপাতত পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করে দিয়েছেন আমদানিকারকরা।

শ্যামবাজারের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স পবিত্র ভান্ডারের ম্যানেজার বাপন সাহা বাংলানিউজকে বলেন, দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উৎপাদন ও দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকায় গত দুই মাস ধরে ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানির পরিমাণ অনেকাংশে কম। দেশি পেঁয়াজ বাজারে পর্যাপ্ত থাকায় আমদানিকৃত পেঁয়াজের চাহিদা অনেক কম। তারপর আজ থেকে আমদানি বন্ধ থাকবে। সে খবরে বাজারে একটু প্রভাব পড়েছে। কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে। পাশাপাশি দেশি পেঁয়াজের দামও বেড়েছে।

মেসার্স রাজীব ভান্ডারের ম্যানেজার বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তাতে পেঁয়াজ চাষিরা টিকে থাকতে পারে। কিন্তু প্রতি বছর দেখা যায়, পেঁয়াজ উৎপাদনের মৌসুমেও ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। তাতে মার খায় স্থানীয় চাষিরা। ভারতীয় পেঁয়াজের তুলনায় বাংলাদেশি পেঁয়াজের খরচও কম। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে যেন চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে সরকারের খেয়াল রাখা উচিত। এই সময়ে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করে দেওয়ায় যেন অসাধু ব্যবাসায়ীরা ফায়দা লুটতে না পারে।

শ্যামবাজারে পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী মেসার্স মিতালী আড়তের মালিক আব্দুর রহিম বলেন, বর্তমানে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় অনুযায়ী পেঁয়াজের দাম স্বাভাবিক আছে। আমদানি বন্ধের খবরে আজ থেকে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে। সামনে রমজান তাই পেঁয়াজের চাহিদা বেড়েছে। চাহিদা বাড়লে দামও বাড়ে। কিন্তু বাজারে পেঁয়াজের কোনো সংকট নেই। মূলত আমদানি বন্ধ হওয়ায় হঠাৎ বাজারে চাহিদা বাড়ার কারণেই দাম একটু বেড়েছে। এখন পেঁয়াজের ভরা মৌসুম। এই দাম না পেলে কৃষকরা পেঁয়াজ উৎপাদন করবে না।  

তিনি বলেন, কৃষকের পেঁয়াজ বাজারে আসলে দাম আবার কয়েকদিনের মধ্যে কমে যাবে। এছাড়া কাঁচামালের দাম সব সময় ওঠানামা করে। তবে সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে, যাতে কোনো অসাধুব্যসায়ী কারসাজি না করতে পারে।

যশোরের পেঁয়াজ চাষি আমিন হোসেন বলেন, যখন দেশি পেঁয়াজ ওঠে তখন ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানি অব্যাহত থাকায় আমরা অনেক সময় উৎপাদন খরচ ওঠাতে পারি না। আর কদিন বাদে ঘরে নতুন পেঁয়াজ উঠবে। এর আগে সরকার পেঁয়াজ আমদানি নিষিদ্ধ রাখায় আমরা খুশি। বাজারে দামও ভালো আছে।

বেনাপোল বন্দরের পেঁয়াজ আমদানিকারক শামিম হোসেন জানান, চাহিদা কম থাকায় এবার রোজার আগে পেঁয়াজ আমদানির চিন্তা নেই। তবে যেহেতু চাহিদার তুলনায় দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন হয় না, তাই একেবারে আমদানি নিষিদ্ধ না করে কোটা নির্ধারণ করে সীমিত রাখলে দাম বাড়ার সম্ভাবনা কম থাকতো।

বেনাপোল বন্দর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থ বছরের ছয় মাসে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে ৯ হাজার ৮৮৭ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। ১৫ মার্চের পর থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকবে। যদি নতুন করে কোনো নির্দেশনা না আসে, তাহলে এরপর থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ হয়ে যাবে।

হিলি স্থলবন্দরের পেঁয়াজ আমদানিকারক সেলিম রেজা ও শহীদ উদ্দিন বলেন, আমদানির অনুমতি বন্ধ হলে রমজানে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যেতে পারে। রমজান আসতে আর কয়েক দিন বাকি। এই সময় দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বেশি থাকে। ফলে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতিপত্র সরকার বন্ধ করলে দাম নাগালের বাইরে চলে যাবে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ড. গোলাম রহমান বলেন, রমজানে সাধারণত নিত্যপণ্যের চাহিদা স্বাভাবিকের তুলনায় দুই থেকে আড়াই গুণ বেড়ে যায়। একটা অসাধু ব্যবসায়ী চক্র এই সুযোগ নিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এতে পণ্যের দাম স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এ জন্য বাজার ঠিকমতো মনিটরিং করা দরকার।

এ বিষয়ে কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, বৃহস্পতিবার থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ হচ্ছে। যেহেতু এখন পেঁয়াজের ভরা মৌসুম। এখন পেঁয়াজ আমদানি হলে কৃষকরা দাম পাবে না। আমরা জানতে পেরেছি পেঁয়াজ পানির দামে বিক্রি হচ্ছে। উৎপাদন খরচ দিয়ে বর্তমানে বাজারে পেঁয়াজের যে দাম তাতে কৃষকরা লোকসানে আছে। তাই আমদানি সাময়িক বন্ধ থাকবে। সরকার যদি প্রয়োজন মনে করে তাহলে আবার আমদানির অনুমতি দেবে। আমদানি যদি সাময়িক বন্ধ হয় তাহলে কৃষকরা লোকসানের হাত থেকে বাঁচবে।

তিনি বলেন, আমদানি বন্ধ হওয়াতে দাম একটু বাড়ছে। তবে সেটা কৃষকের উৎপাদন খরচের সাথে মেলালে সামঞ্জস্যপূর্ণ আছে। এখনও অতিরিক্ত কোনো কিছু হয়নি। আমরা চাই কৃষকরা একটু দাম পাক। তা না হলে কৃষকরা উৎপাদনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। বর্তমানে বাজারে যে দাম আছে সেটা আমি মনে করি ন্যায্যমূল্য আছে। আর কৃষকের কাছে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ রয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে সব পেঁয়াজ বাজারে চলে আসবে। তখন আবার দাম কমে যাবে। তাই পেঁয়াজ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পেঁয়াজের উৎপাদন ভালো হয়েছে।

এদিকে রমজানের আগাম প্রস্তুতি নিয়ে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সন্তোষ প্রকাশ করলেও আমদানিকারক এবং ব্যবসায়ীরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। রমজানের পণ্য আমদানির জন্য পর্যাপ্ত ডলার দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দুইবার বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠানো হয়। এর প্রেক্ষিতে ছোলা, পেঁয়াজ, খেজুর, ভোজ্যতেল, চিনিসহ আটটি নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্যিক ব্যাংক, আমদানিকারক ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০২৩
জিসিজি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।