ঢাকা: সারা বছরের চামড়ার প্রায় অর্ধেকই আসে কোরবানির ঈদের মৌসুমে। তাই সরকার এ বছর চামড়া সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে ব্যাপক প্রচারণা চালানোয় ঢাকার চামড়া ঢাকায় লবণ দেওয়া এবং ঢাকার বাইরের চামড়া যে স্থানে সেখানে লবণ দেওয়ার বিষয়টি সবাই গ্রহণ করেছে। ফলে এ বছর চামড়ার ব্যবস্থাপনা আশা করছি ভালো হবে।
বৃষ্টি ও গরমের কারণে দ্রুত চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। তাই পশুর চামড়া ছাড়ানোর ৪ থেকে ৮ ঘণ্টার মধ্যে লবণ দিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হয়; তা না হলে ওই চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। ব্যাপক প্রচারণার ফলে এটা করতে সক্ষম হয়েছে সরকার। যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকে, এবার চামড়ার বাজার গত কয়েক বছরের চেয়ে ভালো হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
কোরবানির পশুর চামড়া বেচাকেনা নিয়ে এবারও দেশে যাতে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। সেজন্য শৃঙ্খলা বজায় রাখা, বাজার সম্প্রসারণ, ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা, পরিবেশগত মান বজায় রাখা এবং ফিনিশড লেদার উৎপাদনে সর্বোচ্চ কোয়ালিটি নির্ধারণের ওপর জোর দিয়েছে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়। এ দুই মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ইতোমধ্যে খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করা হয়েছে। সে সব বৈঠকে ব্যবসায়ীরা এ শিল্প খাত বিভিন্ন নীতিগত সহায়তা বাড়ানোর ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, গত বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে সারা দেশে কম দামে চামড়া বেচাকেনা হয়েছে। এমনকি ঢাকা শহরেও চামড়ার নির্ধারিত দাম কার্যকর হয়নি।
এদিকে ২০১৩ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা, ঢাকার বাইরে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। সারা দেশে খাসির চামড়া ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছিল। অন্যদিকে গত বছর ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম ৪৭ থেকে ৫২ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা ছিল। আর খাসির লবণযুক্ত চামড়ার দাম ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এ বছর কোরবানির পশুর লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম গত বছরের চেয়ে ৩ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। ঢাকার বাইরের চামড়ার দাম ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। আর খাসি ও বকরির চামড়ায় দাম গতবারের মতোই রাখা হয়েছে। ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর খাসি-বকরির চামড়ার দাম গত বছরের দামই রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, এ বছর ট্যানারি ব্যবসায়ীরা যদি ইচ্ছা করে দাম কমানোর জন্য গেইম খেলে, তাহলে আমরা চামড়া বিদেশে রপ্তানির অনুমতি দেব। চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। আমরা চাই না সেটা হোক। এ বছরও আমাদের ঘোষণাটি হলো, কারসাজির মাধ্যমে দাম কম নেওয়া, দেওয়া বা চামড়া না নেওয়ার চেষ্টা করলে আমরা ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির অনুমোদন দেব।
চামড়ার দাম মনিটরিং প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দামটা আসলেই মনিটরিং করা দরকার। একটা মনিটরিং কমিটি আছে জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে। সেই মনিটরিং টিম এটি দেখভাল করবে, যাতে করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায়। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে চামড়া নিয়ে রাখলে ১০ শতাংশ চামড়াও রক্ষা করা যাবে না। কারণ আমাদের তেমন কোন সিস্টেম ডেভলপ করেনি।
লবণের দাম প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, লবণের দামটা যেভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে, তা যৌক্তিক নয়। তবে আমাদের শিল্প মন্ত্রণালয় যেহেতু এটি নিয়ন্ত্রণ করে উৎপাদন কতটুকু এবং দাম কত হওয়া উচিত সেগুলো তারা ভালো বলতে পারবে। আমরা চেষ্টা করব দাম যা আছে কোরবানির সময় যেন তার চেয়ে বৃদ্ধি না করা হয়।
এ বিষয়ে পোস্তার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আফতাব খান বাংলানিউজকে বলেন, আমরা গত বছর লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি চামড়া ক্রয় করতে পেরেছি। তবে কিছু চামড়া প্রতি বছরই নষ্ট হয়। এ বছর সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম ৩ টাকা বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে লবণের দামও বেশি। তারপরও আমরা মনে করি ভালো আছে। কিন্তু চামড়া যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না হয় তাহলে দাম থাকে না। এজন্য কোরবানির ৪ থেকে ৮ ঘণ্টার মধ্যে চামড়ায় লবণ দিতে হবে। আমরা এ বছর আশা করছি ২০১৯ সালের থেকে চামড়ার বাজার ভালো হবে। সময়ের মধ্যে যদি চামড়ায় লবণ দিতে পারে তাহলে গত বছরের থেকে নষ্ট কম হবে এবং আমরা যারা এই ব্যবসার সাথে জড়িত সকলে লাভের মুখ দেখব।
তিনি বলেন, ঢাকার চামড়া ঢাকাতে ও ঢাকার বাইরের চামড়া সেখানেই লবণজাত করে সংরক্ষণ করতে হবে। গত বছরও এভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। এতে অনেকটাই সফল হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আমরা সরকার নির্ধারিত দামেই চামড়া বেচাকেনা করব।
আফতাব খান বলেন, এ বছর অনেক গরম। আষাঢ় মাস যখন তখন বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি ও গরম চামড়ার জন্য বিষ-স্বরূপ। এজন্য শত চেষ্টা করেও শতভাগ চামড়া সংরক্ষণ করতে পারি না। গত বছর বাংলাদেশে ১০ শতাংশ চামড়া পুরোপুরি নষ্ট হয়েছিল। আর গুণগতমান নষ্ট হয়েছিল ৫ শতাংশ চামড়ার। এ বছর আশা করছি গত বছরের তুলনায় কম নষ্ট হবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে কোরবানির ৮০ শতাংশ চামড়া সরাসরি ট্যানারিতে চলে যায়। আমাদের পোস্তায় আসে মাত্র ২০ শতাংশ চামড়া। এতে দিন দিন পোস্তা তার নিজের ঐতিহ্য হারাচ্ছে। তবে চামড়া যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য লবণজাত করে চামড়া সংগ্রহের জন্য পোস্তার ব্যবসায়ীরা সাভার, হেমায়েতপুর, আমিনবাজার, বেড়িবাঁধ, কেরানিগঞ্জ, জিঞ্জিরা, টঙ্গী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁও, মুন্সিগঞ্জসহ ঢাকার আশপাশের বেশ কিছু এলাকায় লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা রেখেছেন।
লবণের দাম বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বছর আমাদের কাছে পর্যাপ্ত লবণ আছে। লবণের জন্য চামড়া নষ্ট হবে না। তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর লবণের দাম বস্তাপ্রতি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা বেড়ে ১৩৫০ থেকে ১৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গত বছর কোরবানির সময় ৭৪ কেজির একটি লবণের বস্তার দাম ছিল ১০৫০ থেকে ১১০০ টাকা। এতে করে আমাদের খরচ বেড়েছে। একই সাথে লেবার খরচও বেড়েছে।
ট্যানারি মালিকরা পূর্বের বকেয়া পরিশোধ করেননি জানিয়ে আফতাব খান বলেন, কিছু কিছু ট্যানারি মালিক চামড়া ব্যবসায়ীদের জন্য খারাপ করেছেন। তারা পূর্বের সব টাকা পরিশোধ করেননি। ফলে কোনো কোনো অঞ্চলে চামড়া কেনার টাকার সংকট হতে পারে। এছাড়া তেমন কোনো সমস্যা নেই। ট্যানারি মালিকরা গত দুই বছর ধরে নিয়মিত টাকা পরিশোধ করেছেন। তবে তার আগের বকেয়া এখনও পরিশোধ করেননি।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, গত দুই বছরের তুলনায় চলতি বছর চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় ভালো হবে। কারণ এ বছর সরকার আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। সঠিক দামে বিক্রি করতে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোরবানির প্রথম সাত দিন ঢাকার বাইরের চামড়া ঢুকতে দেবে না। ঢাকার চামড়াও বাইরে যেতে দেওয়া হবে না। সিদ্ধান্তটি খুবই ভালো হয়েছে। এতে চামড়ার গুণগত মান ভালো থাকবে।
তিনি বলেন, এ বছর ৮০ থেকে ৮৫ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ হতে পারে। গত বছরও এ রকমই কেনা হয়েছিল। তবে এ বছর মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো না, পশুর দামও বেশি সেজন্য কোরবানি কম হবে। এ বছর চামড়ার দাম নির্ধারণ ঠিক আছে। তবে আমরাও বা কী করতে পারি। আমরা যেটা করতে পারি কেউ যেন দাম কম না দেয় সেখানে নজরদারি বাড়াতে পারি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর কোরবানিযোগ্য মোট গবাদিপশুর সংখ্যা ১ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টি, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ১১ হাজার ৯৪৪টি বেশি। এর মধ্যে ৪৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭৫২টি গরু-মহিষ, ৭৬ লাখ ৯০ হাজার ছাগল-ভেড়া এবং ২ হাজার ৫৮১টি অন্যান্য প্রজাতির গবাদিপশু। কোরবানিযোগ্য পশুর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৮ লাখ ৯৫ হাজার ৪৫৪টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ২০ লাখ ৫৩ হাজার ১২৮টি, রাজশাহী বিভাগে ৪৫ লাখ ১১ হাজার ৬১৪টি, খুলনা বিভাগে ১৫ লাখ ১১ হাজার ৭০৮টি, বরিশাল বিভাগে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ২০৬টি, সিলেট বিভাগে ৪ লাখ ১০ হাজার ২২৫টি, রংপুর বিভাগে ১৯ লাখ ৬২ হাজার ৯৫১টি এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৬ লাখ ৯৮ হাজার ৪৭টি কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু রয়েছে। এ বছর কোরবানির পশুর সম্ভাব্য চাহিদা ১ কোটি ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭৩৯টি। সে হিসেবে এ বছর ২১ লাখ ৪১ হাজার ৫৯৪টি পশু উদ্বৃত্ত রয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এই চামড়ার ৬০ ভাগের বেশি সরবরাহ মেলে কোরবানির মৌসুমে। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৭ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০২৩
জিসিজি/এমজেএফ