ঢাকা, শুক্রবার, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ মে ২০২৪, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

শিল্পে সংকট কাটাতে নীতিসহায়তা চান এলপিজি অপারেটররা

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০২৩
শিল্পে সংকট কাটাতে নীতিসহায়তা চান এলপিজি অপারেটররা

দেশে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহারের বার্ষিক পরিমাণ ১৮ লাখ টনে পৌঁছেছে। এর ১৩ শতাংশই ব্যবহার করছে শিল্পপ্রতিষ্ঠান।

অথচ মাত্র পাঁচ বছর আগেও এর পরিমাণ ছিল ২ শতাংশ।

এ তথ্য জানিয়েছেন এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলওবি) নেতারা। তারা বলেন, শিল্পে সংকট কাটাতে নীতিসহায়তার জন্য জ্বালানি সচিবের নেতৃতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠক করেছেন তারা। শিল্পকারখানায় এলপিজি ব্যবহারে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যায় এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। বৈঠকে এলপিজি ব্যবসায়ী ও শিল্পমালিকরা প্রাথমিকভাবে বেশ কিছু প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন। এলওবি নেতৃবৃন্দ বলেন, এ বিষয়ে খুব দ্রুত একটি গেজেট তৈরি হতে যাচ্ছে।

বৈঠকে উপস্থিত এক দায়িত্বশীল সূত্র জানান, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জ্বালানি সচিবের নেতৃত্বে একটি বৈঠক হয়। সেখানে এলওবির নেতৃবৃন্দসহ এলপিজি খাতের ব্যবসায়ীসহ শিল্পমালিকরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে শিল্পকারখানায় এলপিজি গ্যাস ব্যবহারে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে এলওবির পক্ষ থেকে একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক বর্তমান হাইড্রোকার্বন ইউনিটের ডিজি। আগামী তিন মাসের মধ্যে এ খাতের ব্যবসায়ীদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বরাবর একটি প্রস্তাব পাঠাতে হবে।

বৈঠকে যেসব শিল্পে গ্যাসের দামের প্রভাব কম তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এলপিজিতে আনার বিষয়েও আলোচনা হয়। আর এলপিজিতে আনতে হলে এসব শিল্পের অবকাঠামো তৈরিতে যে বিনিয়োগ লাগবে তা দিতে মালিকদের কোনো সমস্যা না থাকলেও এজন্য প্রচুর ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হয়। এ ভ্যাট-ট্যাক্স যাতে কম বা না দিতে হয় এজন্য শিল্পমালিকদের সরকারের কাছে প্রস্তাব দিতে হবে এমন প্রস্তাবও দেওয়া হয়। বৈঠকে এ ধরনের বেশ কিছু প্রস্তাব এলপিজি ব্যবসায়ীরা প্রাথমিকভাবে উপস্থাপন করেছেন।

এ ছাড়া এলপিজি ব্যবহারে প্রয়োজনীয় যে যন্ত্রপাতি লাগবে সেগুলো যাতে কর ছাড়া আনা যায় সে বিষয়েও আলোচনা হয়। জাতীয় নির্বাচনের পর এ কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক হবে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এলপিজি ব্যবসায়ীসহ শিল্পমালিকদের এ প্রস্তাবগুলো লিখিত আকারে জমা দিতে হবে। আশা করা হচ্ছে, জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে এ-সংক্রান্ত একটি ড্রাফট দাঁড়াবে। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে একটি গেজেটও তৈরি হবে।

এলপিজি অপারেটরসহ সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন এ প্রক্রিয়া খুব দ্রুত হবে। প্রাকৃতিক গ্যাসস্বল্পতার কারণে কারখানার উৎপাদন ধরে রাখতে শিল্পমালিকরা বিকল্প জ্বালানি হিসেবে এলপিজি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন। অর্থাৎ শিল্প খাতে ক্রমেই এলপিজির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিজেলের চেয়ে এলপিজি ব্যবহারে খরচ অর্ধেক হয়। অর্থাৎ এলপিজির ব্যবহার তুলনামূলক সাশ্রয়ী। আবার বর্তমানে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় শিল্পমালিকরা বাধ্য হয়েই এলপি গ্যাসের দিকে ঝুঁকছেন। হিটিং, ডায়িং, সিরামিক শিল্প ও স্টিল মিল এবং ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ বিভিন্ন শিল্পে এলপিজি ব্যবহার হয়। দেশে ৫৮টি প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস ব্যবসার লাইসেন্স পেলেও ২০-২২টি প্রতিষ্ঠান বাজারে সক্রিয় আছে। সরকারি কৌশলগত নীতিসহায়তা পেলে শিল্প খাতে এ জ্বালানি ব্যবহারের পরিমাণ আসছে বছরগুলোয় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন দেশের এলপিজি অপারেটররা।

এর আগেও সরকার সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস বা (সিএনজি) খাতে এ ধরনের নীতিসমর্থন দিয়েছে। এজন্য এখন থ্রি-হুইলার যানে সিএনজি ব্যবহার বাধ্যতামূলক। শিল্পমালিক এবং এলপিজি অপারেটরদের জন্য সহায়ক কিছু নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে শিগগিরই প্রাকৃতিক গ্যাসের পর বিকল্প জ্বালানি হিসেবে এলপিজি জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। বর্তমানে সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো নীতিসহায়তা না থাকলেও চাহিদার কারণে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এলপিজির ব্যবহার কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

এলওবির সভাপতি আজম জে চৌধুরী বলেছেন, শিল্প খাতে এলপিজির প্রচুর সম্ভাবনা আছে। এটি পরিবেশবান্ধব জ্বালানি। শিল্প খাতে এলপিজি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে যন্ত্রপাতি প্রয়োজন সেখানে কর কমালে ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। একটি কারখানায় যখন প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ নেওয়া হয় তখন এর ফি লাগে ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে এলপিজির সংযোগ ফি মাত্র দেড় থেকে সর্বোচ্চ ২ কোটি টাকা। কিন্তু শিল্পমালিকরা এ দেড়-২ কোটি টাকা খরচ করার বদলে মনে করেন, এ টাকা খরচ করার দরকার নেই, প্রাকৃতিক গ্যাস সংযোগের তারা পেয়ে যাবেন। কিন্তু গ্যাস সহজে পাওয়ার সম্ভাবনা যে নেই, এ বিষয়টিও নীতিমালায় আনতে হবে। শিল্পমালিকদের এও বুঝতে হবে, তারা যদি গ্যাস সংযোগ পেয়েও যান তবে সেটি আগের দামে পাবেন না। আবার গ্যাসের চাহিদা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে দ্রুত গ্যাসের সংযোগ যে শিল্পমালিকরা পাবেন এমন নয়। কারণ এখনো দেশে নতুন কোনো গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি। যে প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন করছে তাদের আগে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ দিতে হবে। আর যেগুলো বাণিজ্যিক যেমন সিরামিক কারখানা এগুলোয় এলপিজি নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। এতে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর চাপ কমবে। যে কারখানাগুলো নতুন এবং উচ্চ উৎপাদন সেক্টরে নেই তাদেরও এলপি গ্যাস নেওয়ার জন্য বলা যেতে পারে। এ বিষয়গুলো একত্র করে নীতিমালা তৈরি হলে শিল্প খাতে এলপি গ্যাস গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেতে পারে।

বসুন্ধরা গ্রুপের সেক্টর-এ’র হেড অব স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনের প্রধান এবং বসুন্ধরা এলপি গ্যাস লিমিটেডের জাকারিয়া জালাল বলেন, আমরা চাই শিল্প খাতে এলপিজির প্রসার বৃদ্ধি পাক। এলপিজি এখন সহজেই পাওয়া যায়। আমরা প্রচুর পরিমাণে এ জ্বালানি সরবরাহ করতে পারব। বর্তমানে দেশে যে গ্যাসস্বল্পতা আছে তার পুরো চাহিদা এলপিজি দিয়ে মেটাতে না পারলেও উল্লেখযোগ্য অংশ মেটানো যাবে। বয়লার, বেকারি, বার্নার এসব শিল্পে এলপিজি সরবরাহ করা যাবে। শিল্প খাতগুলোকে ক্যাটাগরি করে যে শিল্পগুলো প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়া চালানো সম্ভব সে শিল্পগুলোয় আমরা যাতে এলপিজি সরবরাহ করতে পারি সে ধরনের নীতিমালা তৈরি করা উচিত।

অরিয়ন গ্যাস লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার ইঞ্জিনিয়ার অনুপ কুমার সেন বলেন, অনেক এলপিজি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এখন আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। শিল্প খাতে এর ব্যবহার বাড়াতে পারলে এলপিজি খাত লাভবান হবে। একটি কারখানায় এলপিজি ব্যবহার করতে হলে কিছু যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হয়। সরকার যদি এসব যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে কিছু সময়ের জন্য কর মুক্ত করে দেয় তাহলে ব্যবসায়ীরা এলপিজি ব্যবহারে উৎসাহিত হবেন। এতে একদিকে যেমন গ্যাসের অভাবে কোনো কারখানা বন্ধ হবে না, আবার প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর চাপও কমবে। এলপিজি অপারেটরদের কারখানায় এলপিজি বিক্রি করতে হলে ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। এ ভ্যাট মওকুফ করে দিলে আমরা যেভাবে আমদানি করছি শিল্পমালিকরাও আমদানিকৃত মূল্যে এলপিজি পাবেন। এর সঙ্গে কারখানাগুলোকে টেকনিক্যাল ও নিরাপত্তা সহায়তা দিয়ে আমরা সহায়তা করব। বর্তমানে অরিয়ন গ্যাস বার্ষিক ১০ হাজার টন এলপিজি সরবরাহ করছে।

পোশাক মালিকদের সংগঠন-বিজিএমইএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম মান্নান বলেন, ডিজেল দিয়ে যখন আমরা পণ্য উৎপাদন করি তখন আমাদের খরচ তিন গুণ বেশি হয়। ডিজেল দিয়ে পণ্য উৎপাদন আমাদের পোষায় না। অতিরিক্ত খরচের কারণে পোশাকশিল্পের মালিকরা অনেকটা বাধ্য হয়েই এখন এলপিজি ব্যবহারে ঝুঁকছেন। লাইনের গ্যাস যখন পাই না, তখন এলপিজি গ্যাসই আমাদের শেষ ভরসা।

বাংলাদেশ সময়: ১২৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০২৩
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।