ঢাকা: গত এক দশকে নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা যে হারে বেড়েছে, সে হারে রাজস্ব আদায় বাড়েনি। ফলে দেশের কর-জিডিপি অনুপাত অনেক নিচে অবস্থান কছে।
আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল তিন লাখ ৮২ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা। একই সময়ে টিআইএনের সংখ্যা ছিল এক কোটি পাঁচ লাখ। আর এক দশক আগে অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। টিআইএন সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৫১ হাজার। ১০ বছরের ব্যবধানে রাজস্ব আদায় বেড়ে তিনগুণ হয়েছে। অন্যদিকে টিআইএন বেড়ে হয়েছে ছয়গুণ।
তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে টিআইএন ছিল ১৬ লাখ ৫১ হাজার, পাঁচ বছর পর ২০১৮-১৯ অর্থবছর টিআইএন বেড়ে হয় ৪১ লাখ ১৯ হাজার। আর পরের পাঁচ বছরে টিআইএন বেড়ে এক কোটি পাঁচ লাখে পৌঁছে।
রাজস্ব আদায়ের চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, টিআইএনের মতো রাজস্ব বাড়েনি। তথ্য অনুযায়ী,২০১৪-১৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয় এক লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। পাঁচ বছরে ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব বেড়ে দাঁড়ায় দুই লাখ ১৬ হাজা ৪৫১ কোটি টাকা। পরের পাঁচ বছরে বেড়ে সর্বশেষ ২০২৩-২৪ রাজস্ব আদায় দাঁড়ায় তিন কোটি ৮২ লাখ ৬৭৮ হাজার টাকা।
গত এক দশকে সরকারি কাজে সেবা নিতে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর বা টিআইএন নম্বর বাধ্যতামূলক করা হয়। এতে নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা বাড়ে। এটিকে রাজস্ব বৃদ্ধির কৌশল মনে বলে মনে করে তৎকালীন সরকার। কিন্তু তারপরও রাজস্ব বাড়েনি, বাড়েনি আয়কর আদায়। ফলে যে সব খাতে টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়, সেসব ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির মতে, বেশি প্রবৃদ্ধি দেখানোর কারণে মোট দেশজ উৎপাদন বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। কিন্তু রাজস্ব বাড়িয়ে দেখানোর সুযোগ না থাকার কারণে এ অঞ্চলে সবচেয়ে কম রাজস্ব-জিডিপি অনুপাতের দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি রাজস্ব আদায় ও মোট দেশজ উৎপাদনের বড় ধরনের অসঙ্গতি সামনে এসেছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৪ অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ছিল ৫০ লাখ ৪৮ হাজার কোটি ২৭ লাখ টাকা। সেই হিসাবে রাজস্ব আদায় হয় জিডিপির ৮ শতাংশেরও নিচে। এ কারণে নিজস্ব সম্পদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না, বিদেশি ঋণের দ্বারস্থ হতে হয়। আবার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেও ঋণ নিতে হয়।
আগের সরকারগুলোর আমলে সবসময়ই রাজস্ব আদায়ের নানা উদ্যোগের কথা বললেও বা উদ্যোগ নিলেও রাজস্ব আদায়ের গতিতে বড় পরিবর্তন হয়নি। রাজস্ব আদায়ে নতুন সময়-পুরোনো সময় বলে কোনো কথা নেই । সবসময়ই রাজস্ব আদায়ের প্রত্যাশা থাকে বলে মনে করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আব্দুল মজিদ।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, রাজস্ব আদায়ের বৃদ্ধি নির্ভর করে দেশের অর্থনীতি এবং রাজস্ব বোর্ড প্রশাসন, অনুশাসন ও সুশাসনের ওপর। ৫ আগস্টের পর দেশ সোনার খনিতে পরিণত হয়ে গেছে, আর রাজস্ব বাড়বে, আর না বাড়লে দুঃখ প্রকাশ করতে হবে, এমন নয়। চেষ্টা চলছে। রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়া একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। রাজস্ব আদায়ে আগে যেমন ব্যর্থতা ও দক্ষতা ছিল, সে অবস্থায় ধারাবাহিকতা রক্ষা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হবে- এমন কোনো সুযোগ এখানে, এভাবে নেই। আর অর্থনীতি থেকে যে রাজস্ব আদায় হবে, অর্থনীতি তো সেইভাবে চাঙ্গা হয়নি বা হচ্ছে না। কিংবা চাঙ্গা হওয়ার পথে রয়েছে নানা সমস্যা। তাছাড়া দুই মাস ধরে একটি আন্দোলন গেলো সেই সময় উৎপাদন সব কিছু বন্ধ ছিল। এতে কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। সরকার পতনের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে সব কিছু কমে গেছে। তারপর ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে আমদানি ধীর হয়েছে, রপ্তানিও হয়েছে ধীর।
মুহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, ব্যাংকগুলো থেকে টাকা লুট হওয়ার কারণে ব্যাংকিং খাত আর সক্ষমতার সঙ্গে কার্যক্রম চালাতে পারছে না। সরকারকে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিয়ে চালাতে হচ্ছে। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ভালো নেই। অর্থনীতি ভালো না হলে রাজস্ব আদায় করা যাবে না।
রাজস্ব আদায় বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সব সময় নেওয়া হয়। ভবিষ্যতেও উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিন্তু রাজস্ব রাতারাতি বাড়বে, এমন বিষয় নয়। সুতরাং আগের সরকারের উদ্যোগ ভালো ছিল বা এই সরকারের সময়ে নেওয়া উদ্যোগ খারাপ হচ্ছে— এভাবে কথা বলার সুযোগ নেই, মনে করেন এনবিআরের সাবেক এ চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, নতুন সরকারের সময় কিছু প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেগুলো অব্যাহত আছে। এর ফলও চটজলদি পাওয়ার কোনো বিষয় নয়, এ ধরনের ভাবারও স্কোপ (সুযোগ) নেই। কারণ চলমান অর্থনীতি থেকে রাজস্ব আসছে। চলমান অর্থনীতিতে যদি না সমস্যা থাকে, আয়-উপার্জন যদি ভালো থাকে, আমদানি-রপ্তানি যদি ভালো থাকে, তাহলে সেটি হবে।
রাজস্ব আদায়ে প্রতিবার একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য ঠিক করা হয়। আর প্রতিবছরই সেই লক্ষ্য অর্জন ব্যর্থ হয়। মাঝপথে কমিয়ে আবার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে হয়।
এ বিষয়ে মুহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, অর্থনীতি যদি চাঙ্গা হয় তাহলে রাজস্ব আদায় বাড়বে, অর্থনীতি যদি ভালো থাকে, তাহলে রাজস্ব বাড়বে। আর আগের সরকারের সময়ে অনুশাসন, প্রশাসন, সুশাসনের কারণে যেসব ক্ষতি হতো, তা যদি থামানো যায়, তাহলে ধীরে ধীরে উন্নতি হবে। এক মাস বা দুই মাসের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ সম্পর্কে মন্তব্য করা যাবে না। আরও সময় লাগবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০২৪
জেডএ/আরএইচ