ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৪ পৌষ ১৪৩১, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

হালতিবিলে হাঁসের রাজ্য, কোটি কোটি টাকার ব্যবসা

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২৪
হালতিবিলে হাঁসের রাজ্য, কোটি কোটি টাকার ব্যবসা

নাটোর: চারিদিকে থৈথৈ করছে পানি। আকাশের কোথাও রৌদ্রময়, আবার কোথাও ভাসমান মেঘে আচ্ছাদিত পরিবেশ।

বাতাসের শব্দ আর ছোট ছোট ঢেউয়ে পানির কলতানিতে যেন বিরাজ করছে এক ভিন্ন প্রকৃতি-পরিবেশ। এরই মধ্যে সাদা, কালো, ধুসর ও সাদ-কালো কিংবা দুই বর্ণের সংমিশ্রণের পাতিহাঁস, রাজহাঁস ও চিনাহাঁসের প্যাক প্যাক ডাক আর ঢেউয়ের তালে তালে ডানা মেলে পানিতে খেলা করার অসাধারণ দৃশ্য।  

বর্ষা এলেই এমন চিত্র দেখা যাবে নাটোরের দ্বিতীয় বৃহত্তম হালতিবিলে। এ বিলের বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি আর পরিবেশ বিমোহিত করবে যে কাউকেই। সঙ্গে রয়েছে হাঁস-পাখির রাজ্য।  

এছাড়া অথৈ পানিতে ভেসে আছে ছোট ছোট গ্রাম। যেন একেকটা দ্বীপ।

এ বিলের মাঝে খোলাবাড়িয়া, হালতি, দিঘীরপাড়, একডালা, কোচকুড়িসহ আশপাশের গ্রামের প্রতিটি বাড়ির নারীরাই লালন পালন করেন বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস।  

এসব হাঁস পালনে একদিকে তারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বি হচ্ছেন, অন্যদিকে পূরণ করছেন মাংস ও ডিমের চাহিদা। বর্ষার অবসর সময়ে গল্প-আড্ডার ফাঁকে তারা হাঁস পুষে আয় করতে পেরে খুব খুশি। এজন্য প্রতিটি বাড়িতেই দিন দিন হাঁস পালন বাড়ছে।  

জানা যায়, জেলার দ্বিতীয় বহত্তম বিল হালতিবিলের প্রতিটি গ্রামের শতভাগ মানুষই কৃষিজীবী। কৃষি কাজই তাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র উৎস। তাই মৌসুম এলেই সব কৃষক চাষাবাদ করেন ধান, পাট, সরিষা, পেঁয়াজ, ভুট্টা, গমসহ হরেক রকম ফসল। তবে ফসল ঘরে তোলার পর বর্ষার সময় এখানকার মানুষের সময় কাটে অনেকটাই কর্মহীন। কেননা এসময় তাদের কোনো কাজ থাকে না।

তাই পারিবারিক কাজকর্ম আর গবাদি পশু দেখাশুনার পর পুরুষদের বেশির ভাগ সময় কাটে গল্প-আড্ডায়। আর বাড়ির কাজ শেষ করে কাঁথা সেলাই, নলি দিয়ে জাল বুনে সময় কাটান গ্রামীণ নারীরা। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে হালতিবিলের গ্রামাঞ্চলের এ চিত্র বদলেছে। গ্রামীণ নারীরা এখন এ অবসর সময় কাটান হাঁস-মুরগি পুষে। বিশেষ করে হাঁস পালনে লাভ বেশি হওয়ায় এটাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন তারা।

বর্ষাকালের শুরুর দিকে এবং বিলে বন্যার পানি প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই এ বিলের নারীরা হাঁসের ডিম ও বাচ্চা সংগ্রহ করেন। অনেকে ডিম থেকে বাচ্চা তোলেন। কেউ কেউ বাচ্চা কিনে পারিবারিকভাবে হাঁস পালনে নেমে পড়েন। প্রাকৃতিক উৎস, বাড়ির উচ্ছিষ্ট খাবার, শামুক-ঝিনুক, ধানের কুড়া, ধান-চাল আর ঘাস খেয়ে সহজেই লালন পালন করতে পারেন রাজহাঁস, পাতিহাঁস ও চিনাহাঁস। মাত্র চার থেকে পাঁচ মাসেই হাঁসগুলো হয়ে ওঠে পরিপক্ক এবং বিক্রি উপযোগী।

এছাড়া ডিমপাড়া তো রয়েছেই। একেকটি পাতিহাঁস বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা দরে। তারা হাঁস আর ডিম বিক্রি করে আয় করছেন অনায়াসে। কেননা এসব হাঁস পালনে তাদের বাড়তি কোনো খরচ করতে হয় না। বরং বর্ষা মৌসুমে স্বল্প খরচে হাঁস পালনে খুব সহজেই স্বচ্ছলতা আসে তাদের। ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার পাশাপাশি সংসারের বাড়তি খরচ মেটানো থেকে শুরু করে বোরো মৌসুমে চাষাবাদেও পরিবারকে খানিকটা সহযোগিতা করা যায়। তাই বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সময় এসব হাঁস বিক্রি করে বোরো চাষাবাদের খরচ যোগান দিতে টাকা প্রস্তুত রাখেন তারা।

হালতিবিলের খোলাবাড়িয়া গ্রামের তানজিলা বেগম জানান, এবার বর্ষার শুরুতেই বিশেষ করে আষাঢ় মাসেই তিনি ৫০টি পাতিহাঁসের ডিম কিনে বাচ্চা তোলেন এবং লালন পালন করে সেগুলোর মধ্যে ৪০টি বড় করেছেন। কিছু কিছু হাঁস ডিম দিচ্ছে এবং বেশির ভাগই মাংস খাওয়ার উপযোগী হয়েছে। বর্তমানে প্রতিটি হাঁস ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এসব হাঁস পালনে তেমন একটা খরচ হয়নি। কারণ বাড়িতেই ধানের কুড়া, চাল, খাবারের উচ্ছিষ্ট এবং বিলের শামুক-ঝিনুক খেয়ে বড় হয়েছে। বাড়তি কোনো খাবার কিনে খাওয়াতে হয়নি। বর্তমান বাজারে বিক্রি করলে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা পাওয়া যাবে।

ছালেহা বেগম, সাবিনা বেগমসহ অনেকেই জানান, প্রতিটি রাজহাঁসের বাচ্চা সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় কিনতে হয় আর ডিমের দাম কমপক্ষে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা করে পড়ে। লালন পালন শেষে প্রতিটি রাজহাঁস ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। প্রতিটি রাজহাঁস চার/পাঁচ মাস লালন পালন করতে খুব সামান্য খরচ করতে হয়। কারণ এসব হাঁস সারাদিন বিলের পানিতে থাকে। এসময় ঘাস, পোকা-মাকড় খায়। সন্ধ্যা লাগলেই বাড়িতে ফিরে আসে। তবে বাড়িতে কুড়া, খড় এবং মাঝে মধ্যে খাবারের উচ্ছিষ্ট খাওয়ানো হয়। বিলের হাঁস ফিডমুক্ত এবং স্বাস্থ্য সম্মত। এছাড়া এসব হাঁস পালন লাভজনক।

একই গ্রামের দরগাপাড়ার জহুরা বেগম জানান, প্রতিটি বাড়িতেই রাজহাঁস, পাতিহাঁস ও চিনাহাঁস রয়েছে। তবে পাতিহাঁস ও রাজহাঁসের সংখ্যা বেশি। পাতিহাঁস কুড়া, চাল, খাবারের উচ্ছিষ্ট এবং বিলের শামুক-ঝিনুক খায়। আর রাজহাঁস ধান-চাল, বিভিন্ন রকম ঘাস খেয়ে বড় হয়। তিনি এবার ২০টি রাজহাঁস ও ৪৫টি পাতিহাঁস লালন পালন করেছেন।  

তিনি বলেন, প্রতিটি পাতিহাঁস ৫০০ টাকা, রাজহাঁস ২০০০ টাকা এবং চিনাহাঁস ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাড়ি থেকেই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন পাইকাররা। তবে মাঝে মধ্যে হাট-বাজারেও বিক্রির জন্য পাঠানো হয়।

একডালা গ্রামের আছিয়া বেগম বলেন, হাঁস পালন লাভজনক হওয়ায় এবার ৬০টির মতো রাজহাঁস লালন পালন করে বিক্রি উপযোগী করেছি। এরই মধ্যে ১০টি হাঁস দুই হাজার টাকা করে বিক্রিও করেছি। বোরো ধান চাষাবাদের আগেই সবগুলো বিক্রি করব। এছাড়া প্রায় ৪০ থেকে ৪৫টি পাতিহাঁস রয়েছে।  

তিনি বলেন, গ্রামের এমন কোনো বাড়ি নেই, যেখানে বর্ষায় হাঁস থাকে না।  

একই কথা জানান, হালতি, দিঘিরপাড়, কোঁচকুড়ি গামের নারীরা।

একডালা গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় খাচুরা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য মো. জামাল হোসেন বলেন, বিল এলাকার হাঁস দেখতে যেমন সুন্দর এবং নাদুস-নুদুস, খেতেও সুস্বাদু। কারণ ফিড ছাড়াই প্রাকৃতিক উৎস থেকে শামুক খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে এসব হাঁস। যা স্বাস্থ্যসম্মত এবং স্বাদেও অতুলনীয়। খামারের হাঁসের তুলনায় বিলের হাঁস অনেক ভালো। এজন্য শহর থেকে অনেকেই এসব হাঁস কিনতে আসছেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এসে হাঁস কিনে শহরের বাজারগুলোতে বিক্রি করছেন। আবার অনেকেই এলাকায় এসে হাঁস কিনে পিকনিক করছেন।  

তার মতে, হালতিবিল এখন অনেকটাই হাঁসের রাজ্য।  

নাটোর জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় ২৫০টি পারিবারিক ও বাণিজ্যিক হাঁসের খামার রয়েছে। এর মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করা হাঁসের খামারের সংখ্যা ২১টি। এসব হাঁসের খামারে সাত লাখ ৫৫ হাজার ৮২৩টি পাতিহাঁস ও ১০ হাজার ৮৫৫টি রাজহাঁস লালন পালন করা হয়। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ হাঁসের খামার রয়েছে শতাধিক। এসব খামারে লালন পালন করা হয় অন্তত পাঁচ লাখ হাঁস।

অন্যদিকে স্থানীয় সূত্র মতে জানা যায়, এ বর্ষায় হালতিবিলের প্রতিটি বাড়িতে গড়ে অন্তত ৩০ থেকে ৫০টি করে রাজহাঁস এবং গড়ে ৪০ থেকে ৭০/৮০টি করে পাতিহাঁস বা দেশি হাঁস লালন পালন করেছেন নারীরা। এতে এ বিল এলাকায় বর্ষাকালে কমপক্ষে ১০ লাখ হাঁস লালন পালন হয়েছে। সেই সঙ্গে উৎপাদন হচ্ছে কয়েক লাখ ডিম। যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাজারজাত করা সম্ভব হচ্ছে।

নাটোর জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ড. জুলফিকার মো. আখতার হোসেন এ তথ্য নিশ্চত করে বাংলানিউজকে জানান, শামুক-ঝিনুক, পোকামাকড়, ভুসি ও ভাত খাওয়াতে পারলে হাঁস পালন সহজ এবং খরচও কম হয়। এতে হাঁস পালন লাভজনক হয়। আর বাড়ি বাড়ি ও পারিবারিকভাবে হাঁস পালন করা গেলে মানুষের খাদ্য তালিকায় মাংস ও ডিমের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। হালতিবিল ও চলনবিলের বাড়ি বাড়ি নিজ উদ্যোগে হাঁস পালন করছেন অনেকে। মাংস ও ডিমের চাহিদা মিটিয়ে বাজারজাত করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন তারা। এটা একটা ইতিবাচক দিক। এজন্য গ্রামীণ নারীদের হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশু লালন পালনে প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে উদ্ধুদ্ধ করা হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, জেলায় ডিমের চাহিদা ১৯ কোটি ২৪ লাখ পিস। সেখানে ডিম উৎপাদন হচ্ছে ৪৫ কোটি ৭৮ লাখ পিস। যার বাজার মূল্য ৫৮৫ কোটি টাকা। জেলায় মোট মাংসের চাহিদা এক লাখ ২৫ হাজার ৩০৮ মেট্রিক টন। সেখানে মাংস উৎপাদন হয় এক লাখ ২১ হাজার মেট্রিক টন। হাঁস লালন পালনের ফলে একদিকে মাংস ও ডিমের চাহিদা মিটছে, অপরদিকে আর্থিকভাবে লাভ হচ্ছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২৪
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।