ঢাকা: নতুন বছর দ্বারে কড়া নাড়ার আগেই পুস্তক প্রকাশনা ও মুদ্রণ শিল্পের ব্যবসায়ী, কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্টদের ব্যস্ততা শুরু হয়। বছরের প্রথম মাসে তো ২৪ ঘণ্টাই কাজের মধ্য থাকতে হয়।
এ সময়টাতেই তাদের ব্যবসার সিংহভাগ আয় হয় পুস্তক প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্পে।
কিন্তু চলতি বছরে একেবারে ভিন্নচিত্রের দেখা মিলছে ওই দুই শিল্পে। ২০ দলের ডাকা টানা অবরোধ ও হরতালে সব হারিয়ে এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে তাদের।
মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন না নতুন বই তৈরির অর্ডার। আর প্রকাশকেরা পাচ্ছেন না কাগজ, কারিগর ও যানবাহনের সুবিধা। চড়া দামে কিনতে হচ্ছে কাগজ।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা এবং বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির দাবি, চলতি মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতায় তাদের ক্ষতি হয়েছে, ৫০০ কোটি টাকার বেশি। এভাবে চলতে থাকলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে।
এদিকে, হরতাল-অবরোধের কিছুটা জের পড়েছে রোববার (০১ ফ্রেব্রুয়ারি) শুরু হওয়া একুশে বই মেলার ওপর। শঙ্কা দেখা দিয়েছে, সময় মতো বই প্রকাশনা নিয়েও।
সরেজমিনে রাজধানীর বাংলাবাজার, নয়াবাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাবাজারের মাঝামাঝি যেতেই চোখে পড়ে ইউনাইটেড প্রিন্টিং প্রেসের সামনে এর স্বত্ত্বাধিকারীসহ কর্মচারীদের দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য। তবে মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছেন সবাই।
কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই উৎকণ্ঠা আর ক্ষোভ নিয়ে ওই প্রেসের স্বত্ত্বাধিকারী আবদুর রহমান বললেন, গত বছরের এই দিনে আমরা ২৪ ঘণ্টা কাজের মধ্যে ছিলাম। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম মাসের (জানুয়ারি) গত কয়েকদিন টুকটাক কিছু কাজ করলেও গত দুইদিন ধরে কোনো কাজ নেই।
তিনি জানান, প্রতি বছর এ সময়টাতেই তাদের সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত সময় পার করতে হয়। কিন্তু এবার দাঁড়িয়ে-বসে অলস সময় পার করতে হচ্ছে। কাঁধে লোকসানের বোঝা নিয়ে বছর পার করতে হবে।
বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় সব ধরনের কাগজ রিমপ্রতি এক থেকে দুইশ’ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাবাজারের আরশী পেপার হাউজের কাগজ বিক্রেতা রবিউল আউয়াল রিপন বাংলানিউজকে জানান, বর্তমানে ৮০ গ্রামের (২৩x৩৬) কাগজ রিমপ্রতি ২০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে এক হাজার আটশ’ টাকায় ও (২০x৩০) দেড়শ’ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে এক হাজার তিনশ’ ৫০ টাকায়।
আর ৭০ গ্রামের কাগজ (২৩x৩৬) ২০০ টাকা বেড়ে এক হাজার ছয়শ’ টাকায় এবং (২০x৩০) দেড়শ’ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে এক হাজার একশ’ ৫০ টাকায়।
বই বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, অন্যান্য বছরের এ সময়ে এ সব বাজারে পা ফেলার জায়গা মেলে না। ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই তিন মাস ক্রেতা, বিক্রেতা, কারিগর, ব্যবসায়ীসহ সবার উপস্থিতিতে বই তৈরির বাজারগুলোতে আনন্দঘন এক পরিবেশ বিরাজ করে। কিন্তু এখন সম্পূর্ণই ভিন্ন চিত্র। থেমে থেমে কাজ চলছে।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আলমগীর শিকদার লোটন বাংলানিউজকে বলেন, প্রকাশনা শিল্পে এই মৌসুমকে ‘ঈদ মৌসুম’ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরিতায় কাজ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ইতোমধ্যে, ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে, দুইশ’ কোটি টাকার বেশি।
তিনি জানান, বড় বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের অনুপস্থিত থাকা, সময়মতো ও প্রয়োজনীয় কাগজ না পাওয়ার কারণে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে প্রকাশকদের। এছাড়া লেখকরা প্রকাশকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। ফলে, বই প্রকাশ করতেও সমস্যা হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে একুশে বইমেলায়।
সমিতির সূত্র জানায়, এ শিল্পের সঙ্গে প্রকাশক ও বিক্রেতা নিয়ে সারাদেশে প্রায় ২১ হাজার সদস্য রয়েছেন। এর সঙ্গে হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান ঝুঁকিতে পড়বে হরতাল ও অবরোধের কারণে।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান শহীদ সেরনিয়াবাদ বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের ব্যবসা খুবই ভালো চলছিল। আমাদের ব্যক্তিগত প্রয়াসে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। কিন্তু, হরতাল ও অবরোধের মতো আত্মঘাতি কর্মসূচি আমাদের পেছনে ফেলে দিচ্ছে। এ কারণে বইমেলার বইও ঠিকমতো ছাপানো যাচ্ছে না।
তিনি জানান, সাত হাজার প্রেসের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় চার লাখ মানুষ সম্পৃক্ত রয়েছেন। তাদের সবাই আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। ইতোমধ্যে, তারা প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
প্রকাশক ও মুদ্রণ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্তদের জোর দাবি, শিগগিরই হরতাল ও অবরোধের কর্মসূচি তুলে নেওয়া হোক। নইলে, এ শিল্পকে এ সব কর্মসূচির আওতামুক্ত রাখা হোক।
বাংলাদেশ সময়: ০১৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৫
** মোটরবাইকে দু’জন উঠে পুলিশের পিটুনি খেলেন সাংবাদিক-শিক্ষার্থী