ঢাকা: সরকারের দেওয়া বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্ত মালামাল এনে দেদারছে খোলাবাজারে বিক্রি করছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। তাই তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে পারছেন না প্রকৃত ব্যবসায়ীরা।
এছাড়া ব্যাংকে এলসি খুলে কারসাজি করে বিদেশে টাকা পাচার ও ব্যাপক রাজস্ব ক্ষতিরও অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগের ভিত্তিতে প্রায় ১৮ মাস ধরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদন্ত চালায়। তদন্তে দেখা যায়, ঢাকার নিবন্ধিত মোট ছয় হাজার ৩০০টি বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মধ্যে দুই হাজার ৪৩৪টিই অকার্যকর রয়েছে; এর মধ্যে আবার ৪৭৭টির অস্তিত্বই নেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন প্রতিষ্ঠান ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের এই তদন্তে অকার্যকর এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম খাতে সরকারের পাওনা নির্ধারণ করা হয়েছে তিন হাজার ৭৯০ কোটি টাকা।
২০১৩ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের ১৫ মার্চ পর্যন্ত প্রায় ১৮ মাস ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের আওতাধীন ছয় হাজার ৩০০ বন্ডেড ওয়্যারহাউস সরেজমিন পরিদর্শন, কাগজপত্র যাচাই, আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত তথ্য খতিয়ে দেখে কর্মকর্তারা ১৬ মার্চ প্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদনে এসব হিসাব উল্লেখ করেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, দুই হাজার ৪৩৪টি অকার্যকর বন্ডেড ওয়্যারহাউসের কাছে সরকারের পাওনা তিন হাজার ৭৯০ কোটি ৫৩ লাখ ৩০ হাজার ৭৬২ টাকা। অস্তিত্বহীন ৪৭৭টি বন্ডেড ওয়্যারহাউসের কাছে সরকারের পাওনা ৭২৬ কোটি ৫১ লাখ ৬৬ হাজার ৬০৪ টাকা। অকার্যকর বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মধ্যে সার্টিফিকেট মামলা দেওয়া হয়েছে ২০৩টির বিরুদ্ধে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারের পাওনা ৪০৫ কোটি ৭৫ লাখ ৭৭ হাজার ১০ টাকা। হিসাব জব্দ করা হয়েছে ১২৩টির। অকার্যকর সব বন্ডেড ওয়্যারহাউসের আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত সব ব্যাংকিং লেনদেন বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং তাদের লাইসেন্স সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।
ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের রেজিস্ট্রারে উল্লেখ আছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে 'ভেজা গার্মেন্টস লিমিটেড' বন্ড সুবিধায় প্রায় পাঁচ বছর ধরে শুল্কমুক্ত পণ্য আমদানি করছে। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানটির বন্ডেড ওয়্যারহাউসে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে দেখেন, নির্দিষ্ট ঠিকানায় এ নামে কোনো বন্ডেড ওয়্যারহাউস ও গার্মেন্ট কারখানা নেই। তদন্তে দেখা যায়, অস্তিত্বহীন এ বন্ডেড ওয়্যারহাউস শুল্কমুক্ত পণ্য আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করছে। প্রতিষ্ঠানটিকে অনিয়ম বাবদ ৪৫ কোটি ৫৩ লাখ ৫১ হাজার ১৩১ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়। প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়; বন্ধ করা হয় আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত কার্যক্রম। সাময়িক স্থগিত করা হয় ব্যবসার লাইসেন্স।
আরেক প্রতিষ্ঠান আবু প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ। প্রায় ১০ বছর ধরে এটি শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পের তালিকায় আছে। প্রতিষ্ঠানটি শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করে নিয়মিত রপ্তানি করছে বলে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ আছে। কমিশনারেটের কর্মকর্তারা সরেজমিনে প্রতিষ্ঠানটির কারখানা ও বন্ডেড ওয়্যারহাউসের নির্দিষ্ট ঠিকানায় গিয়ে দেখেন, খালি একটি গোডাউন পড়ে আছে। ওয়্যারহাউস ও কারখানায় কাগজপত্র, যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, উৎপাদিত পণ্য, কর্মকর্তা, কর্মচারী কিছুই নেই। তদন্তে পাওয়া যায়, অকার্যকর এ বন্ডেড ওয়্যারহাউস ও কারখানার নামে শুল্কমুক্ত পণ্য আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। তদন্তের পর আবু প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃপক্ষকে ৪৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত সব কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। এ ছাড়া ব্যবসার লাইসেন্সও সাময়িক স্থগিত করা হয়।
ওয়ান প্যাকেজিং লিমিটেড বন্ড সুবিধায় কাগজ তৈরির কাঁচামাল ডুপ্লেক্স বোর্ড আমদানির অনুমতি পায় ১৪২ টন। এ পরিমাণ পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করে প্রতিষ্ঠানটি খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয় এবং সরকারের ৬০ লাখ টাকার রাজস্ব ক্ষতি করে। একইভাবে পোর্ট সিটি পোলিও অ্যান্ড এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজের বন্ডেড ওয়্যারহাউসের নামে বিওপিপি ও ডুপ্লেক্স বোর্ড আমদানিতে প্রায় তিন কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়ে। এতে সরকার ৮২ লাখ টাকার রাজস্ব হারায়। এসব পণ্যও কাগজশিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
এভাবে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের তদন্তে দুই হাজার ৪৩৪টি বন্ডেড ওয়্যারহাউসেই অনিয়ম-দুর্নীতির এ ধরনের চিত্র মিলেছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা কাস্টমস কমিশনারেটের কমিশনার ড. সহিদুল ইসলাম বলেন, বন্ডেড ওয়্যারহাউসের ছয় হাজার ৩০০টি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি আমাদের সীমিত জনবল নিয়ে পরিদর্শনসহ সব ধরনের তদন্ত করেছি। যেসব প্রতিষ্ঠান মিথ্যা তথ্য দিয়ে শুল্কমুক্ত পণ্য আমদানি করছে, তাদের চিহ্নিত করেছি। এ খাতে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। তদন্ত শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি সরকারের পাওনা দাবি করা হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত দেশীয় শিল্প
পুরান ঢাকা এলাকার নয়াবাজার, হাশেম টাওয়ারসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গার্মেন্টে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে আমদানি করা শুল্কমুক্ত পণ্য খোলাবাজারে দেদার বিক্রি হচ্ছে। গার্মেন্ট কারখানার সংশ্লিষ্ট বন্ডেড ওয়্যারহাউসের কর্মীরা এজেন্টের মাধ্যমে এসব পণ্য দোকানে দোকানে পৌঁছে দিচ্ছেন। রাজস্ব পরিশোধ করে আনা একই জাতীয় পণ্যের চেয়ে শুল্কমুক্ত পণ্য কম দামে পাওয়ার সুযোগ থাকায় বেশির ভাগ দোকানি বিপুল উৎসাহে সেগুলো কিনছে। দোকানিরা আবার এসব পণ্য খুচরা ও পাইকারি বাজারে বিক্রি করে।
সবচেয়ে বেশি বন্ডেড সুবিধা পায় গার্মেন্টশিল্প। বর্তমানে ঢাকার ছয় হাজার ৩০০টি বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মধ্যে চার হাজার ২২৬টিই গার্মেন্টস বন্ড। আবার অকার্যকর ও অস্তিত্বহীন বন্ডেড ওয়্যারহাউসগুলোর মধ্যে গার্মেন্টস বন্ডই এক হাজার ৭৩৬টি। তদন্তে চলতি বছরের জানুয়ারিতে শুধু গার্মেন্টস বন্ডগুলোতে অনিয়ম খাতে সরকারের পাওনা ৭২৯ কোটি দুই লাখ ৪৯ হাজার টাকা। এ সময় অন্যান্য খাতের বন্ডেড ওয়্যারহাউসের অনিয়মে সরকারের পাওনা ৫৪ কোটি তিন লাখ ৯২ হাজার টাকা। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে শুধু গার্মেন্টস বন্ডের অনিয়মে সরকারের পাওনা ২৫৭ কোটি ৮৭ হাজার টাকা। একই সময়ে অন্যান্য খাতের বন্ডে অনিয়ম হয়েছে ছয় কোটি ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, একটি গার্মেন্ট কারখানায় ব্যবহারের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় ৫০ হাজার গজ কাপড় আমদানি করে ২০ হাজার গজ ব্যবহার করে বাকি ৩০ হাজার গজ খোলাবাজারে বিক্রি করে দিলেও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের আটকের সুযোগ নেই। এভাবে গার্মেন্টস বন্ড থেকে কাগজ তৈরির কাঁচামাল ডুপ্লেক্স বোর্ড, বিওপিপিসহ নানা রকম উপকরণ শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা হচ্ছে।
বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সচিব নওশেরুল আলম বলেন, গর্মেন্টের কাঁচামাল হিসেবে বিশেষভাবে প্যাকেজিংয়ে ব্যবহারে যেসব কাঁচামাল, কাগজ আমদানি হয় তা খোলাবাজারে বিক্রি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এতে দেশীয় কাগজ শিল্প কঠিন সমস্যায় পড়ছে। শুল্কমুক্ত পণ্য কম দামে বিক্রি করা হয়। অন্যদিকে দেশীয় কারখানায় নিয়ম মেনে উৎপাদন করায় উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে। এতে দেশীয় শিল্প অসম প্রতিযোগিতার কারণে মার খাচ্ছে। এ অনিয়ম বন্ধে সরকারের কঠোর নজরদারির দাবি জানান তিনি।
অর্থপাচার
অভিযোগ আছে, শুল্কমুক্ত পণ্য আমদানিতে ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। এ ক্ষেত্রে ক্রেতা বন্ডেড হাউস কর্তৃপক্ষ ও বিদেশি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমঝোতায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা পণ্যের ধরন ও মূল্য নির্ধারণ হচ্ছে।
এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খোলার ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কী ধরনের পন্য আনা হবে এবং তার দাম কত হবে, এ সম্পর্কিত তথ্যে মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। যে পণ্য আনার কথা থাকে, আদৌ তা আনা হয় না। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য ছাড়িয়ে নিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ঊর্ধ্বতন শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকে পণ্যের উচ্চমূল্য দেখিয়ে যা আনার কথা থাকে তা আদৌ কনটেইনারের মধ্যে থাকছে না। উদাহরণ দিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, পণ্যের মূল্য বাবদ এক কোটি টাকা পরিশোধ করে ৩০ লাখ টাকার পণ্য আনলে বাকি ৭০ লাখ টাকা হিসাবের বাইরে থাকছে। এ ক্ষেত্রে ৭০ লাখ টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে লোকবলের অভাবে এবং আধুনিক প্রযুক্তি না থাকায় এ অপকর্ম অনেক সময় কাস্টমসের চোখ এড়িয়ে যায়। বন্ড সুবিধার পক্ষে কাগজপত্র থাকায় কাস্টমসের যাচাই-বাছাইয়ে পড়তে হয় না বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। এভাবে মিথ্যা ঘোষণায় বড় অঙ্কের অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারে অর্থনীতিতে একদিকে কালো টাকা যোগ হচ্ছে, অন্যদিকে প্রচুর অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে এখনই সতর্ক না হলে সৎ ও প্রকৃত ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান বলেন, বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্ত পণ্য এনে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী প্রকৃত ব্যবসায়ীদের বিপদে ফেলছে। এ বিষয়ে এনবিআর কাজ করছে। দুর্নীতিবাজ বন্ডেড ওয়্যারহাউস চিহ্নিত করতে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে। অনিয়ম বন্ধ করা না হলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা অসম প্রতিযোগিতায় পড়বেন এবং লোকসানের মুখে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন। এতে পুরো অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৫