ঢাকা: নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমদানি নির্ভরতা ছাপিয়ে স্বনির্ভর হয়েছে দেশের পোল্ট্রি খাত। চাহিদা মাফিক বেড়েছে উৎপাদন।
অল্প সময়ে দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে এ খাতটি। কিন্তু হঠাৎ করে এ খাতের ওপর সরকারের করারোপের সিদ্ধান্তে মুখ থুবড়ে পড়ছে শিল্পটি। ইতোমধ্যে নতুন বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে। দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে বাজারের এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
গার্মেন্টস শিল্পের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে পোল্ট্রি শিল্প। বর্তমানে এ শিল্পে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৪০ ভাগই নারী। বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প সমন্বয় কমিটির (বিপিআইসিসি) তথ্য মতে, সারাদেশে বর্তমানে প্রায় ৬৫-৭০ হাজার ছোট-বড় খামার আছে। জিডিপিতে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান প্রায় ২.৪ শতাংশ।
পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা জানান, আশির দশকে পোল্ট্রি শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৫শ’ কোটি টাকা। বর্তমানে বিনিয়োগ ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সরকারের সহযোগিতা পেলে ২০২১ সাল নাগাদ বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।
হাঁটিহাঁটি পা পা করে ঘুরে দাঁড়ানো এ খাত ফের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। তবে এবারের বিপর্যয় বার্ড ফ্লু বা রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্যে নয়। করমুক্ত এ খাতে ১৫ শতাংশ করারোপের কারণে।
সরকারের করারোপের সিদ্ধান্তে অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে পোল্ট্রি খামারি ও উদ্যোক্তারা, বন্ধ হয়ে গেছে নতুন বিনিয়োগ বলে জানান বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প সমন্বয় কমিটির আহবায়ক মো. মসিউর রহমান।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, প্রতিবছর এ খাতে নতুন ১০ শতাংশ বিনিয়োগ হয়। করারোপের কারণে এবার কোনো নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। এটা আমরা এখন বুঝতে পাচ্ছি। দেড় দুই বছরের মধ্যে সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে এর প্রভাব পড়বে, তখন সবাই বুঝবে।
মসিউর রহমান বলেন, ২০০৭-১১ সাল পর্যন্ত বার্ড ফ্লু’র ফলে এ খাতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। বন্ধ হয়ে যায় ৫০ শতাংশের বেশি খামার। এরপরই আবার যুক্ত হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। এতে পুঁজি হারিয়েছেন বহু ব্যবসায়ী। কিন্তু কর অব্যাহতি সুবিধার ফলে আমরা থেমে থাকিনি। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি করেছি। যার কারণে গত ৫-৭ বছরে মুরগি বা ডিমের দাম বাড়েনি। মুরগির দাম কেজিতে ১৩০-১৪০ আর প্রতি পিস ডিম ৮-৯ টাকার মধ্যে ছিল এবং তা বর্তমানেও আছে।
নতুনভাবে করারোপ হলে এ শিল্পে আবারও বিপর্যয় নেমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশে জনপ্রতি মুরগির মাংস খাওয়ার পরিমাণ বছরে ৩ দশমিক ৬৩ কেজি। বর্তমানে মুরগির মাংসের দৈনিক উৎপাদন প্রায় ১৭০০ মেট্রিক টন। একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন প্রায় এক কোটি।
২০২১ সাল নাগাদ দৈনিক প্রায় ৪ কোটি ২৬ লাখ ডিম ও প্রায় সাড়ে তিন হাজার মেট্রিক টন মুরগির মাংসের প্রয়োজন হবে। বিনিয়োগ দরকার হবে প্রায় ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকার।
এর মধ্যে পোল্ট্রি শিল্পের ওপর নতুনভাবে করারোপ হলে এ শিল্পের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। মুরগির ডিম ও মাংসের দাম বৃদ্ধি পাবে এবং এ শিল্পে বিনিয়োগের গতি শ্লথ হয়ে পড়বে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিইএ) মহাসচিব ডা. এম এম খান।
পোল্ট্রি শিল্পের বিভিন্ন কাঁচামালে শুল্ক-করসহ ১৫ শতাংশ করারোপের ফলে নতুন বিনিয়োগ বন্ধ হওয়ায় ইতোমধ্যে হতাশ হয়েছেন ব্যবসায়ী ও খামারিরা। ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কয়েকটি খামার ঘুরে এমন তথ্যই জানা যায়।
রূপগঞ্জের চনপাড়ায় তিনটি পোল্ট্রি খামারের মালিক মোহাম্মদ নোমান। পৃথক তিন কাঠা জায়গায় করেছেন এসব খামার। বাংলানিউজকে তিনি জানান, একেকটা খামারে এক হাজার থেকে ১২-১৩শ’ মুরগি পালন করা যায়। এসব মুরগি উপযুক্ত হতে ২৬ দিন সময় লাগে। এ সময়ের মধ্যে একটি মুরগি ১-১.৫ কেজি খাবার খায়। প্রতি কেজি খাদ্য ৪৪ টাকা, বাচ্চা কেনা পড়ে ২৫ টাকা, খাবার আনা, ওষুধ, স্যালাইনসহ আছে বিভিন্ন খরচ। এরপর ছয় হাজার টাকা করে খামার প্রতি তিনজন কর্মচারীকে দিতে হয় বেতন।
তিনি বলেন, সব মিলিয়ে তেমন আয় করতে পারি না। কারণ পাইকারি বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম ৯০-১০০। খুচরা বাজারে ১২০-১৩০ টাকা। অথচ নিম্নমানের মাছ পঙ্গাসের দামও ১৫০ টাকা কেজি।
রূপগঞ্জের খামারি ও ব্যবসায়ীরা জানান, এই খাতের ওপর করারোপের সিদ্ধান্ত কতটা আত্মঘাতী এটা সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহল আগামী দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে বাজারের প্রভাব পড়লে বুঝতে পারবে। তখন তারা বুঝলেও বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে আরও দু’বছর সময় লেগে যাবে। এজন্য এখনই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তারা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৫
এসইউজে/টিআই