ঢাকা: চীন, ভারত সহ বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারের টালমাটাল অবস্থা। ‘ইমার্জিং’ অর্থনীতি হিসেবে পরিচিত উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে মন্দা।
বিশ্বের বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের ওপর দৃষ্টি দিতে গেলে অবশ্যই চোখ বুলিয়ে নিতে হবে এই সব শিরোনামের ওপর। এর সঙ্গে আমলে নিতে হবে বিশ্বের বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক নানা সমীকরণকেও।
মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অনেকদিন ধরেই ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত বিশ্বের প্রধান দুই তেল উৎপাদনকারী রাষ্ট্র ইরান ও সৌদি আরব। গোদের ওপর বিষফোঁড়া আইএস এর উত্থান। সিরিয়াকে কেন্দ্র করে এক সময়ের ঘনিষ্ঠ রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে শুরু হয়েছে টানাপড়েন। উত্তর কোরিয়ার হাইড্রোজেন বোমা পরীক্ষার জেরে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি। দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে চীনের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর দ্বন্দ্ব।
সব মিলিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে এই মুহূর্তে সবচেয়ে কঠিন ও জটিল সময় অতিবাহিত করছে পুরো বিশ্ব।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন নতুন বছরে বিশ্ব অর্থনীতি কোন পথে। কিংবা এসব সঙ্কট উত্তরণের আশু কোনো সমাধান আছে কি না,তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানা মুনির নানা মত।
বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের দুর্দশার চিত্রটি প্রথম প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয় গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে। ২০১৫ সালের ২৭ জুলাই চীনের শেয়ার বাজারে নামা ধসে টালমাটাল হয়ে পড়ে পুরো বিশ্বের শেয়ার বাজার। আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা হাতে থাকা শেয়ার তাড়াহুড়ো করে ছেড়ে দিতে শুরু করলে হুড়মুড় করে পড়তে থাকে বাজারগুলোর সূচকের পারদ।
সেই দিনটি সোমবার ছিল বলে ওই ঘটনাকে তাই অভিহিত করা হয় ‘ব্ল্যাক মানডে’ হিসেবে। এরপর আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি চীনা অর্থনীতি। ভারতসহ এশিয়ার প্রায় সবকটি বাজার ও পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব শেয়ারবাজারেও লাগে চীনা ফ্লুর ধাক্কা।
ছয় মাস যেতে না যেতেই প্রায় একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে এ বছরের ৭ জানুয়ারি। বাজারে লেনদেন শুরুর ১৫ মিনিটের মধ্যেই ৫ শতাংশ সূচক পতনের জেরে বিপর্যয়ের শঙ্কায় সেদিনের মত শেয়ারবাজারই বন্ধ করে দেয় চীনা কর্তৃপক্ষ। প্রভাব পড়ে ভারতসহ এশিয়ার অন্যান্য শেয়ার বাজারেও।
চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটকে তাই চীনা সঙ্কটের প্রভাব বলে অভিহিত করছেন অনেক বিশেষজ্ঞই।
তাদের মতে চীনের বাজার তেজি থাকলে ভালো থাকে বিশ্ব অর্থনীতির স্বাস্থ্য। আর তাদের অর্থনীতি দুর্বল হলে প্রভাব পড়ে পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতেই। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর এর প্রভাব চোখে পড়ে আরও বেশি করে।
বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটকে ‘চায়নিজ ফ্লু’ হিসেবে অভিহিত করে মর্গান স্ট্যানলির অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ রুচির শর্মা বলেন, এর আগে সংঘটিত বিশ্বের প্রতিটি অর্থনৈতিক সঙ্কটই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো। কিন্তু এবারের বিষয়টি ব্যতিক্রম। বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি চীন। যদি চীন ডোবে তবে ডুববে আরও অনেক ছোট বড় অর্থনীতি। আর যদি চীন ঘুরে দাঁড়ায় তবে সঙ্কট কেটে যাবে দ্রুতই।
এই মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হচ্ছে চীন। ১৯৯০ থেকে শুরু করে ২০০৯ সাল পর্যন্ত, এই ২০ বছরের অর্থনৈতিক ‘ট্রেন্ডজ’ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ সময়ে বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রায় তিন ভাগের এককভাবে ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের দখলে। পক্ষান্তরে চীনের দখলে ছিলো মাত্র ১২ ভাগ।
কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত এই ৫ বছরে বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৩৪ শতাংশের অবদান চীনের। যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ১৭ শতাংশ। একই সঙ্গে বিশ্বের অর্থনৈতিক উৎপাদনের দশ শতাংশও এই সময়ে চীনের দখলে। এজন্য বিশ্ব চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণ অনুধাবনে চীনের অর্থনীতির উত্থানপতনকে মনোযোগের সঙ্গে নজর রাখার জন্য মত বিশ্লেষকদের।
চীনা অর্থনীতির বর্তমান সঙ্কটের জন্য দায়ী করা হচ্ছে তার বিপুল জাতীয় ঋণকে। চীনের জাতীয় ঋণ তার জিডিপির ২৮০ শতাংশ। এই বিপুল জাতীয় ঋণ চীনের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বাড়তি চাপের সৃষ্টি করছে। ফলে মন্থর হয়ে পড়েছে চীনের প্রবৃদ্ধি।
অথচ ২০০৯ সালের আগে পর্যন্ত পরিস্থিতি মোটামুটি স্থিতিশীলই ছিলো। ২০০৯ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটের পর দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করে চীন। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে গিয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে হয়। বেড়ে যায় জাতীয় ঋণও। এখন এই বিপুল জাতীয় ঋণই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে চীনের জন্য।
চীনের অর্থনৈতিক এই সঙ্কটের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে অন্যান্য দেশেও। ধস নেমেছে ভারতের শেয়ারবাজারেও। সঙ্কুচিত হয়েছে ভারতের রফতানি খাতও। ২০১০ সাল থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই ৫ বছরে ভারতের রফতানির ধারা ঋণাত্মক। এই সময়ে তাদের রফতানি হ্রাস পেয়েছে দশমিক ৫ শতাংশ।
ভারতের এই অবস্থার জন্য অনেকেই দেশটির সংরক্ষণ মূলক বাণিজ্য নীতিকে দায়ী করছেন। ২০০৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ভারত ৫০৪টি বাণিজ্য সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছে ৩৭৭টি ও চীন ২২২টি পদক্ষেপ। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের প্রতি এটি নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে বলেই মত বিশ্লেষকদের।
শঙ্কার মধ্যে রয়েছে ভারতের কর্পোরেট জগতও। ২০০৪ সালে ভারতের শীর্ষ ৫শ’ কোম্পানির গড় বিক্রয় প্রবৃদ্ধি ছিলো ২৫ শতাংশ। অথচ ২০১৫ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে শূন্য শতাংশে।
গত বছর বিশ্ববাজারে তেলের দাম পড়তির দিকে থাকায় অনেকেই একে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিশেষ করে যেসব দেশ তেল আমদানির ওপর নির্ভরশীল তাদের জন্য আশীর্বাদ বলে মনে করেছিলেন।
কিন্তু তেলের দাম বর্তমানে ব্যারেলপ্রতি ৩০ ডলারের আশপাশে ঘোরাফেরা করলেও, খুব একটা লাভ হচ্ছে না উন্নয়নশীল দেশগুলোর। বিশ্ববাজারে চাহিদা কম থাকায় কমে গেছে এসব দেশের রফতানি। ফলে তেলের দাম হ্রাসের সুফল উন্নয়নশীল দেশগুলোর থেকে বেশি পাচ্ছে উন্নত দেশগুলো। এক্ষেত্রে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৫০ থেকে ৬০ ডলারে স্থির থাকলে তা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সহায়ক হবে বলে মত বিশ্লেষকদের।
বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আর একটি ট্রেন্ডজ হলো বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির হ্রাস। কিন্তু এর সুফলও পাচ্ছে না উন্নয়নশীল দেশগুলো। উন্নত দেশগুলোতেও মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাওয়ায় এসব দেশের বাজার হারিয়ে ফেলছেন উন্নয়নশীল দেশগুলোর রফতানিকারকরা। ফলে আন্তর্জাতিক বাজার হারিয়ে নিজেদের উৎপাদিত পণ্য তারা বাজারজাত করছেন স্থানীয় বাজারেই। এর প্রভাবে স্থানীয় বাজারে জিনিসের দাম কমছে।
সাময়িকভাবে এতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নিম্ন আয়ের ভোক্তারা উপকার পেলেও। দীর্ঘমেয়াদে তা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর বলেই প্রমাণিত। কারণ টার্গেট মার্কেট অর্থাৎ রফতানি বাজার হারানোর কারণে ফের বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না উন্নয়নশীল দেশের উৎপাদনকারীরা। ফলশ্রুতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরো অর্থনৈতিক চক্র।
রফতানির বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে শুধু অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর জোর দিয়ে বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না কোনো উন্নয়নশীল অর্থনীতিই।
ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বৃদ্ধিও বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বিশ্বের সমস্ত মুদ্রাব্যবস্থার ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ডলারের সাথে সম্পর্কিত। তাই মার্কিন ডলারের উত্থান পতনের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির উত্থান পতনও অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।
উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশেষ করে যেসব দেশ উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা করছে ফেডের সুদের হার বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের ফলে সঙ্কটের মুখে পড়বে তারা। ফেডের সুদ বৃদ্ধি পাওয়ায় উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে সরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ শুরু করবে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা।
বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রভাবে দেশে দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনও অস্থির হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক সঙ্কট সামাল দিতে না পারায় বিশ্বের দেশে দেশে গণতান্ত্রিক সরকারগুলো পরবর্তী মেয়াদে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে সংশয়ে পড়তে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিশ্ব অর্থনীতিতে ২০০৩ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সময়কে স্থিতিকাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ সময়ে বিশ্বের ত্রিশটি গণতান্ত্রিক দেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রেই পুননির্বাচিত হয়েছিলো ক্ষমতাসীন সরকারগুলো।
পক্ষান্তরে ২০০৯ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটের পর এখন পর্যন্ত এই হার অর্ধেক। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর জন্য সামনে কঠিন দিন অপেক্ষা করছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্বের চলমান ভূ-রাজনৈতিক সঙ্কটও বিশ্ব অর্থনীতিতে কালো ছাঁয়া ফেলছে। ২০১৫ সালেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে ১ লাখেরও বেশি মানুষ। সবচেয়ে বেশি অস্থিতিশীল বিশ্বের তেলভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত মধ্যপ্রাচ্য। তার ওপর সিরিয়া নিয়ে তুরস্ক ও রাশিয়া, ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্ব। বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নানামুখী টানাপড়েন।
এসব ক্ষেত্রে আপদকালীন কৌশল প্রণয়নে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি সাফল্যের পরিচয় দেবে সঙ্কটে তারাই টিকে থাকবে সবচেয়ে ভালোভাবে।
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি এমনভাবে একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এক দেশের সঙ্কটের প্রভাবের বাইরে নয় অন্যান্য দেশগুলোও।
বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য নীতি প্রণয়ন করা তাই সময়ের দাবি।
বাংলাদেশ সময়: ০১১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৬
** হটমানি, ফেডারেল রিজার্ভ আর তেলে টালমাটাল বিশ্বের শেয়ারবাজার
** এখন শুরু মৃত্যু, প্রাণ বাঁচাতে মূত্রপান, তবুও নীরব!
** সোয়া বছরেই দিল্লির মসনদে গলদঘর্ম মোদি