ঢাকা: তৈরি করেন স্বাস্থ্য হানিকর তামাকজাত পণ্য বিড়ি (হাতে তৈরি ফিল্টার বিযুক্ত)। হয়ে আসছেন শ্রেষ্ঠ করদাতাও।
কিশোরগঞ্জের সুবোধ বিড়ি কারখানার মালিক রঙ্গরানী দাস। মূসক চালান-১১ ইস্যু না করে ও বিক্রয় হিসাব পুস্তকে সকল বিক্রয় হিসাব সংরক্ষণ না করে মূসকসহ রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন ৪০ কোটি টাকা।
সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড’র নির্দেশে মূসক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের অভিযানে রাজস্ব ফাঁকির এ চিত্র বেরিয়ে এসেছে। মূসক গোয়েন্দার একটি সূত্র বাংলানিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
মূসক গোয়েন্দা অধিদফতরের সহকারী পরিচালক একেএম সুলতান মাহমুদ, মো. ছানা উল্লাহ, মো. সেলিম উল্লাহসহ আটজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে কিশোরগঞ্জ জেলার পাঁচজন শ্রেষ্ঠ করদাতাকে পুরুস্কার দেওয়া হয়। সুবোধ বিড়ি কারখানার চেয়ারম্যান রঙ্গরানী দাস সেই বছর প্রথম শ্রেষ্ঠ করদাতা হিসেবে পুরুস্কার পান।
সে থেকে প্রতিবছর শ্রেষ্ঠ করদাতার পুরুস্কার পেয়ে আসছেন। সুবোধ বিড়ি ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বত্রিশ বছরে পা রেখেছে। রঙ্গরানীর মৃত্যুর পর ছেলের স্ত্রী লাবনী দাস কারখানা পরিচালনা করেন।
বত্রিশ কিশোরগঞ্জ, শোলাকিয়াস্থসহ জেলায় রঙ্গরানী দাসের মালিকানাধীন সুবোধ বিড়ির চারটি কারখানা রয়েছে। এর প্রধান কার্যালয় কিশোরগঞ্জের বড় বাজার এলাকায়।
সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটি বিড়ি বিক্রয়ের বিপরীতে মূসক-১১ চালান ইস্যু করে না রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে-এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের। পরে কারখানা ও বড় বাজার কারখানার প্রধান কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়।
কর্মকর্তারা কারখানায় ৩ বস্তা (৩২ কেজি করে ৯৬ কেজি) তামাক পাতা, ১৪ লাখ বিড়ির নিচের অংশের লেবেল ও ৭২ হাজার পিস লেবেল মজুদ পেলেও কোন ব্যান্ডরোল (মূসক আদায় পদ্ধতি) পায়নি।
কর্মকর্তারা জানতে পারেন, কোম্পানির চারটি কারখানায় বিড়ির তৈরির পর ব্যান্ডরোল ব্যবহার করা হয় না। এবং বাজারজাত করার ক্ষেত্রে মূসক চালান-১১ ইস্যু করা হয় না। এর মাধ্যমে মূসক ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে।
কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে অভিযান চালায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা কোন প্রকার তথ্য দিতে রাজি হননি। পরে মূসক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা একটি তালাবদ্ধ কক্ষের সন্ধান পায়।
কক্ষের বাইরে তালা দিয়ে ভেতরে কাজ করছে কর্মচারীরা। পরে তালা খুলে ২৩টি মূসক চালান-১১ বই, মূসক-১৬ সাতটি রেজিস্ট্রার, সাতটি বিক্রয় হিসাব পুস্তক (মূসক-১৭), দুইটি মূসক-১৮ রেজিস্ট্রার, ৩টি টালি খাতা, ৪৪টি গদি বই, ২টি ডায়েরি, ৩৫টি ফাইল, ৩ ব্যান্ডেল উৎপাদন হিসাব বিবরণী ও একটি কম্পিউটার সিপিও জব্দ করে।
পরে কর্মকর্তারা বিক্রয় হিসাবের সাথে বাণিজ্যিক খাতায় লিপিবদ্ধ বিক্রয়ের ব্যাপক গরমিল পান। জব্দ করা দলিলাদি পর্যালোচনা করে ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত রাজস্ব ফাঁকির চিত্র পান। তবে ২০১০ ও ২০১১ সালের কোন হিসেব দিতে পারেনি কারখানা কর্তৃপক্ষ।
সূত্র জানায়, কোম্পানির চারটি কারখানার দলিলাদি পর্যালোচনা করে ৬০ কোটি ১১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৪১ টাকার বিপরীতে মূসক, আবগারি শুল্ক ও এর বিপরীতে অনাদায়ি রাজস্বের সুদ হিসেবে রাজস্ব ফাঁকি পাওয়া যায়।
এরমধ্যে সম্পূরক শুল্ক ও মূসক হিসেবে ২৩ কোটি ৩৯ লাখ ১০ হাজার ৬২৫ টাকা ৩২ পয়সার রাজস্ব ফাঁকি খুঁজে পান।
এরমধ্যে পরিহারকৃত সম্পূরক শুল্ক ১২ কোটি ৪৯ লাখ ৮৬ হাজার ২৩৮ টাকা ২৮ পয়সা ও মূসক হিসেবে ১০ কোটি ৮৯ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৭ টাকা ৪ পয়সা ফাঁকি পান।
মূসক আইন, ১৯৯১ এর ৩৭(৩) ধারা অনুযায়ী পরিহারকৃত রাজস্বের ওপর ২ শতাংশ মুনাফা অনুসারে ১৬ কোটি ৮৬ লাখ ৩৩ হাজার ৬৬০ টাকা ৬৯ পয়সা আদায়যোগ্য।
কোম্পানির চারটি প্রতিষ্ঠান মূসক চালান-১১ ইস্যু, ব্যান্ডরোল ব্যবহার না করে, সম্পূরক শুল্ক ও মূসক পরিশোধ না করে এবং মূসকের মুনাফাসহ মোট ৪০ কোটি ২৫ লাখ ৪৪ হাজার ২৮৬ টাকা ১ পয়সা ফাঁকি দিয়েছে।
মূসক কর্মকর্তারা আরো দেখতে পান, কারখানার উৎপাদনস্থলে খাতাপত্র সংরক্ষণ, মূসক নিবন্ধনপত্র কারখানার দৃষ্টিগোচর স্থানে না ঝুলানো ও আয়-ব্যয়ের হিসাব সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে না বলে অভিযোগ পান।
শ্রেষ্ঠ করদাতার প্রতিষ্ঠানে মূসক ফাঁকির বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলার প্রক্রিয়া চলছে।
অভিযোগের বিষয়ে কোম্পানির ম্যানেজার সঞ্জয় কুমার সরকার বলেন, চারটি কারখানার হিসেব কারখানায় না রেখে প্রধান কার্যালয়ে সংরক্ষণ করা হয়। এতে কোন গরমিল নেই।
ব্যান্ডরোল বিষয়ে তিনি বলেন, শতভাগ ব্যান্ডরোল ব্যবহার করা হয়। তবে সব কারখানায় ব্যান্ডরোল থাকে না। ব্যান্ডরোল উত্তোলন করে সোলাকিয়াস্থ কারখানায় রাখা হয়।
প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানেজার রতন কুমার দাস বলেন, বাণিজ্যিক খাতায় চারটি কারখানার হিসেব সংরক্ষণ করা হয়। এতে মূসক ফাঁকি দেওয়ার কোন সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৬
আরইউ/জেডএম