ঢাকা: রানার মোটরবাইকের ইঞ্জিনে জোর নেই। ফ্লাইওভারে কেবল চালককে নিয়ে উঠতে গেলেই ঘড়ঘড় করে।
রানার দুরন্ত নিয়ে এমন দুর্ভোগের কথা জানিয়েছেন এক ব্যবহারকারি। রানারের সার্ভিসে চরম বিরক্ত এই ভুক্তভোগী মাত্র পনেরো দিনের মাথায় বাইকটি বিক্রি করে দেওয়ার কথা ভাবছেন।
আব্দুর রহমান নামে ওই ব্যবহারকারী বাংলানিউজকে বলেন, মাত্র ১৫ দিনের মাথায় এই অবস্থা। সেদিন কুড়িল ফ্লাইওভারে উঠতে পারিনি। সঙ্গে ছিলেন আমার এক বন্ধু। প্রথমে দুই গিয়ার দিয়ে উঠতে শুরু করলে কয়েক হাত উঠার পর ঘড়ঘড় শব্দ করতে থাকে।
এরপর একটি গিয়ার কমিয়ে দেই। তখন বিকট শব্দ করতে থাকে, মনে হচ্ছিল এই বুঝি ইঞ্জিন ব্লাস্ট হয়ে যাবে। ভয়ে স্টার্ট বন্ধ করে দেই। প্রথমে ভেবেছিলাম কোন সমস্যা হয়েছে। কিন্তু পরে স্টার্ট দিলেও একই অবস্থা।
পরে দুই বন্ধু মিলে ঠেলে ফ্লাইওভারের উপরে ওঠেন। তারপর স্টার্ট দিয়ে গন্তব্যে পৌছান। তাদের যাওয়ার কথা ছিল ফার্মগেট। ভয়ে আর মহাখালী ফ্লাইওভারে ওঠেননি। জ্যাম ঠেলে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে ফার্মগেট পৌছাতে হয় বলে জানান আব্দুর রহমান।
তিনি বলেন, এখানেই দুর্ভোগের শেষ হলে খুব একটা আক্ষেপ হতো না। কেনার সময় শুনেছিলাম, প্রতি লিটারে সত্তর কিলোমিটার যাবে। কিন্তু এখন ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার যেতেই এক লিটার পেট্রোল শেষ। সার্ভিস সেন্টারে গিয়েছিলাম। তারা বলেছে, কিছুদিন গেলে ঠিক হয়ে যাবে। তাদের কথার কোন অর্থ বুঝতে পারছি না। এটা কি করে হয়। পুরাতন হলে তো আরও বেশি তেল খাওয়ার কথা।
তিনি বলেন, ১২ দিনের মাথায় প্লাগ জ্বলে গেছে। ঝাঁকুনি খেলে ট্যাংক থেকে তেল উপচে পড়ে যায়। প্রথম দিকে মনে করেছিলাম, হয়তো ট্যাংক ভর্তি থাকার কারণে সমস্যা হচ্ছে। এখন দেখছি ট্যাংকে অর্ধেক তেল থাকলেও একটু ঝাঁকুনিতেই মুখ দিয়ে উছলে পড়ে যায়।
আব্দুর রহমান বলেন, ডানের সিগন্যাল লাইট জ্বালানোর জন্য বোতাম চাপলে প্রথমে বামেরটা জ্বলে। তারপর ডানেরটা জ্বলে ওঠে। সাত দিনের মাথায় ক্যারিয়ারের রঙ উঠে গেছে। ঘণ্টায় পঞ্চাশ কিলোমিটারের বেশি গতিবেগ ওঠে না। আবার ৫০ কিলোমিটার স্পিড দিলে ভীতিকর কম্পন শুরু হয়। চলন্ত অবস্থায় প্রায়ই ইঞ্জিনের স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম দিকে এই প্রবণতা কম থাকলেও এখন দিনে চার থেকে পাঁচবার হচ্ছে।
রানারের তেজগাঁও সার্ভিস সেন্টারে গিয়েছিলাম। তারা বলেছে, নতুন নতুন সব গাড়ি এমন সমস্যা করে। পরে ঠিক হয়ে যাবে। এখন আমি যাব কোথায়। মাইলেজ নিয়ে কথা বলেছিলাম। তারা বলেছে, ঢাকায় জ্যাম থাকার কারণে বেশিদূর যাচ্ছে না। গ্রামে গিয়ে চালালে ঠিক হয়ে যাবে। তাহলে কি ঢাকায় চাকরি ছেড়ে গ্রামে চলে যাবো শুধু বাইকের জন্য!
ইকরাম নামে অপর এক রানার ব্যবহারকারিও অভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বাইকটি বিক্রির কথা ভাবছেন।
তিনি জানিয়েছেন, মাত্র সতের দিনে ৬ বার সার্ভিস সেন্টারে যেতে হয়েছে মেরামত করার জন্য। মেরামত করতে গেলে দিনটাই মাটি হয়ে যায়। গিয়ে সিরিয়াল নিয়ে বসে থাকতে হয়। কাজ শুরুর পর বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়।
রানার গ্রুপের ম্যানেজার (করপোরেট সেলস) ওয়াসিম বাংলানিউজকে বলেন, ক্রেতারা ৫৯ হাজার টাকা দিয়ে একটি মোটরবাইক কিনছেন। তারা কিন্তু অনেকটা বুঝেই কিনছেন। এতো কম দামে কিনে দেড় থেকে দুই লাখ টাকায় কেনা বাইকের মতো ফিচার পাওয়া কঠিন। তবে বেসিক সেবা পাওয়ার অধিকার কাস্টমারের রয়েছে। সাধারণত এ ধরনের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বিষয়টি না দেখে মন্তব্য করা কঠিন।
তিনি বলেন, কোন কারণে ম্যানুফ্যাকচারের ত্রুটি হয়ে থাকলে আমাদের নজরে আনা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ওই কাস্টমার তাদের তেজগাঁও সার্ভিসিং সেন্টারে গিয়ে ফেরত এসেছেন বলে জানালে রানারের এই কর্তা বলেন, এমন তো হওয়ার কথা নয়।
মাইলেজ কম হওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আসলে কোথায় বাইকটি চলছে সেটাই বড় কথা। রাজধানীতে অনেক জ্যাম, সে কারণে মাইলেজ কোনো গাড়িরই ঠিক থাকে না।
জবাবে বলেন, হাইওয়ের রাস্তায় নিয়ে গেলে একলাফে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মাইলেজ বেড়ে যাবে।
তাহলেও তো আপনাদের ঘোষিত সত্তর কিলোমিটার হয় না। এ কথার জবাব না দিয়ে অন্যপ্রসঙ্গে চলে যান তিনি।
ওয়াসিম বলেন, মাইলেজের বিষয়টি নির্ভর করে বাইকের কার্বুরেটর নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় কি-না তার ওপর। আর সঠিক ইঞ্জিন ওয়েল ব্যবহার হচ্ছে কি-না সেটাও একটা বড় ফ্যাক্টর। বাইকটির বয়স মাত্র পনেরো দিন- এ অবস্থায় এসব প্রসঙ্গ অবান্তর কিনা জানতে চাইলে নীরবতা পালন করেন মানেজার করপোরেট সেলস।
রানারের এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা বাংলাদেশে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছি বাইক বিক্রির ক্ষেত্রে। মানুষ ভালো কারণেই কিনছেন। বছরে কতো বাইক বিক্রি হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা কোম্পানির গোপন বিষয়। আপনাকে বলা যাবে না।
অভিযোগ রয়েছে, চীন থেকে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি এনে এসেম্বলিং করছে রানার গ্রুপ। বাইকগুলোতে নিম্নমানের প্লাস্টিক ব্যাবহার করা হয়েছে। যে কারণে সাইড কভার সামান্য আঘাতে ফেটে যাচ্ছে। তাই এই বাইক কিনে অনেকেই এখন আপসোস করছেন। কেউ কেউ এরই মধ্যে পানির দরে সদ্য কেনা বাইক বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন বলেও এন্তার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
মগবাজার রেলগেট এলাকার রশিদ অটো স্বত্বাধিকারী মোটর মেকানিক আব্দুর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, আমরা রানারের মোটরসাইকেল মেরামত করি না। এলেই বলে দেই ওদের সার্ভিসিং সেন্টারে যাওয়ার জন্য। কারণ এগুলো আজকে মেরামত করে দিলে কালকে আবার অন্য সমস্যা দেখা দেয়। এতে আমাদের সুনাম নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে।
আব্দুর রশিদ বলেন, এক ভদ্রলোক রানারের দূরন্ত বাইক কিনেছেন। তিন মাসের মাথায় তার ক্লাসপ্লেট নষ্ট হয়ে গেছে। আরেকজনের এক হাজার কিলোমিটার চলার পরেই রিং পিস্টন নষ্ট হয়ে গেছে। অথচ, সাধারণ যে কোন নতুন বাইকের ২০ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত রিং পিস্টন কোন সমস্যা হয় না।
চীনের ডায়াং মোটরসাইকেল বিপনণের মাধ্যমে রানার অটোমোবাইলস লিমিটেড এর যাত্রা শুরু হয় ২০০০ সালে। ২০০৭ সালে ময়মনসিংহের ভালুকায় বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো মোটরসাইকেলের কম্পোনেন্টস তৈরির মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে এসেম্বলিং শুরু করে রানার। ২০১১ সালে পানচিং, ওয়েল্ডিং, পেইন্টিং, এসেম্বলিং, টেস্টিং ইত্যাদি মেশিনারিজ স্থাপনের মাধ্যমে মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী হিসাবে সরকারি অনুমোদন লাভ করে।
রানার মোটরবাইক নিয়ে বাংলানিউজ আপনার দুর্ভোগের কথা তুলে ধরতে চায়। আপনার অভিজ্ঞতা জানাতে পারেন news.bn24@gmail.com মেইলে।
বাংলাদেশ সময়: ১১২৫ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০১৬
এসআই/ জেডএম