ঢাকা: ছায়েদুর রহমানের সাড়ে তিন বিঘা সরিষার ক্ষেতে গত বছরের তুলনায় দুই মণ ফলন বেশি হয়েছে। ফসল ঘুরে তুলে হিসাব মেলানোর পর আনন্দে আত্মহারা এই কৃষক।
অন্যান্য বছরের তুলনায় ক্ষেতে আলাদাভাবে যত্ন না নিয়েও হঠাৎ ফলন বাড়ার নেপথ্যের কারণ খুঁজতে শুরু করেন তিনি। পেয়েও যান, ক্ষেতে মৌ চাষের কারণেই ফলন বেড়েছে।
এতো গেলো মানিকগঞ্জের কৃষক ছায়েদুর রহমানের কথা। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, তার মতো যেসব কৃষকের ক্ষেতে মৌ চাষ হয়েছে সবারই ফসলের ফলন বেড়েছে।
সরিষা, কালোজিরা, তিলসহ একাধিক ফসলের সঙ্গে মৌ চাষে ফলন বৃদ্ধিতে হাসি ফুটেছে ওই সব কৃষকের মুখে। আর মৌ চাষিরাও হয়েছেন লাভবান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) ও বিভিন্ন এলাকার কৃষক ও মৌ চাষির সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে এমন চিত্র।
ডিএই সূত্র বলছে, মৌ চাষ হওয়া জমিতে ফসলের ফলন শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে জমির মালিক ও মৌ চাষি উভয়ই লাভবান হচ্ছেন।
ডিএই মহাপরিচালক ও কৃষিবিদ মো. হামিদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, একটি গবেষণা ও মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের কাছ থেকে পাওয়া জরিপে দেখা গেছে, মৌ চাষের জমিতে অনেক বেশি ফলন বাড়ছে। কোথাও কোথাও ২০ ভাগের বেশি ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, তবে এ চিত্র গত কয়েক বছর আগেও এমন ছিল না। ওই সময়ে কৃষকরা মনে করতেন- মৌ চাষে ফলন কমে যাবে। কিন্তু তাদের সঠিকভাবে দিক নির্দেশনা দেয়ায় তারা ভুল বুঝতে পেরেছেন।
এ ঊর্ধতন কর্মকর্তা জানান, তাই যেসব ফসলের সঙ্গে মৌ চাষ করা সম্ভব সেসব ফসলের চাষাবাদ বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপও নিয়েছে ডিএই। কেননা দুই শ্রেণির মানুষ এখান থেকে লাভবান হচ্ছেন। আর এতে দেশে মধুর উৎপাদনও বাড়বে।
কৃষক ছায়েদুর রহমান জানান, প্রতি বছর সাড়ে তিন বিঘা জমিতে সাড়ে নয় থেকে দশ মণ সরিষার উৎপাদন হয়। কিন্তু এ বছর উৎপাদন হয়েছে ১২ মণ। এখান থেকে তিনি প্রায় চার হাজার টাকার বেশি সরিষা পেয়েছেন।
এছাড়া মৌ চাষীদের দেখাদেখি স্বল্প পরিসরে দুটি বাক্স বসিয়ে নিজ জমিতে মৌ চাষ করে এ বছর ৩৫ কেজি মধু ঘরে তুলেছেন ছায়েদুর। এ থেকেও ছয় হাজার টাকা আয় করেছেন মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের কারাইল গ্রামের এ কৃষক।
ডিএই সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরিষা, ধনিয়া, তিল, কালিজিরা, লিচু জাতীয় ফসলের জমিতে মৌ বাক্স বসিয়ে লাভবান হচ্ছেন মৌ চাষীরা।
সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবন বি অ্যান্ড হানি ফার্ম লিমিটেড’র মৌ চাষি আব্দুল জব্বার বলেন, যেসব এলাকায় সরিষা, কালিজিরা, লিচু, ধনিয়ার চাষ বেশি হয়, প্রথমে সেসব এলাকার তথ্য সংগ্রহ করি। এরপর কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্ষেতে মৌ বাক্স বসিয়ে মধু চাষের কার্যক্রম শুরু করি।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার জোড়দিয়া এলাকার এ মৌ চাষি জানান, সরিষার ক্ষেতের জন্য সিরাজগঞ্জ, নড়াইল, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, জামালপুর, মানিকগঞ্জ ও লিচুর বাগানের জন্য চলে যান রাজশাহী অঞ্চলে। এভাবেই সারা বছর চলে তার মৌ চাষ। প্রতিবছরই বাড়ছে তার আয়ের পরিমাণ।
নুরুল হুদা, মোহাম্মাদ এবাদুল্লাহ আফজালসহ একাধিক মৌ চাষি জানান, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বাক্সের ভেতর ‘রানী মৌমাছি’ রেখে মৌ চাষ করা হয়। সরিষা ক্ষেতের পাশে বসানো হয় বাক্স। প্রতিটি বক্সের ভেতর একটি করে ‘রানী মৌমাছি’ ও পাঁচ থেকে দশটি ফ্রেম থাকে। এই ফ্রেমগুলোই হচ্ছে ‘মৌচাক’।
ঘরে বসে থাকা রানী মৌমাছির খাবার (মধু) যোগাতে ঝাঁকে ঝাঁকে কর্মী মৌমাছি ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে এনে জমা করে ওই মৌচাকে।
আট থেকে দশদিন পর চাক থেকে মৌ চাষীরা সংগ্রহ করেন মধু। ‘এফিস মেলিফেরা’ জাতের মৌমাছির চাষ বেশি করা হয়। এরা সাধারণত ২ থেকে ৩ কিলোমিটার দূর থেকেও মধু সংগ্রহ করতে পারে।
মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ও কৃষিবিদ আলীমুজ্জামান মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, সরিষা ও এ জাতীয় ফসলের ফুলে মৌমাছি বসার কারণে ওই ফসলের শতভাগ পরাগায়ন হয়। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি ফলন দানাদার হয়।
তিনি জানান, স্বাভাবিকভাবে চাষে এসব ফসলের পরাগায়ন হয় ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ। কিন্তু মৌ বসায় পরাগায়ন হয় শতভাগ। এ কারণেই ফলন বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৭ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৬
একে/জেডএম