ঢাকা: কোনো ধরনের মান পরীক্ষা, নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারি ছাড়াই দেশে উৎপাদিত, আমদানি বা বাজারজাত করা সকল ধরনের শিশুপণ্যের বিকিকিনি চলছে। কোনো সুনির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড বা কোনো আইন না থাকায় এসব বিষয়ে কোনো ক্ষমতাই নেই রাষ্ট্রীয় মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ স্টান্ড্যার্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউটেরও (বিএসটিআই)।
ফলে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে বড় হচ্ছে এসব পণ্য ব্যবহারকারী দেশের শিশুরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে উৎপাদিত বা বাজারজাত হওয়া কোনো শিশুখাদ্য, শিশু প্রসাধন বা শিশু ব্যবহার্য পণ্যেরই নেই গুণগত মান নির্ণয়, পরীক্ষা, নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির ব্যবস্থা। নেই এসব পণ্যের কোনো সুনির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ডও। ফলে বাজারের সকল শিশুপণ্য যথাযথ নজরদারি ছাড়াই উৎপাদন এবং বিপণন করছে দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলো।
এদিকে আইনে না থাকায় শিশুপণ্যের মান পরীক্ষা বা নিয়ন্ত্রণের কোনো ক্ষমতাই নেই বিএসটিআই’র।
এটাকে এদেশের শিশুদের প্রতি রাষ্ট্রীয় অবহেলা বা সন্ত্রাসের সামিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কেবল রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা বা আইনের বাধ্যবাধকতা না থাকার কারণেই দেশের নতুন প্রজন্ম এ সন্ত্রাস ও অবহেলার শিকার হচ্ছে বলেও মন্তব্য তাদের।
আধুনিক সময়ে সকল বাবা-মা সন্তান জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য বেবিঅয়েল, বেবি শ্যাম্পু, বেবি পাউডার, বেবি লোশন, ডায়াপার, কৌটাজাত শিশুখাদ্য বা অন্যান্য শিশুপণ্য কিনে থাকেন। দেশের নামি-দামি কোম্পানি থেকে শুরু করে বিদেশি বড় বড় কোম্পানির এসব শিশুপণ্যই দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে কোনো ধরনের মান নিয়ন্ত্রণ বা পরীক্ষা ছাড়াই।
এছাড়া চীন, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, কোরিয়া থেকেও আসছে মানহীন নানা শিশুপণ্য। কিন্তু এসবের মান নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই কারো।
ফলে এসব পণ্য ব্যবহারে সবার অজান্তে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে বড় হচ্ছে দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম।
সম্প্রতি ইউরোপের বাজারে বিশ্বখ্যাত আমেরিকান কোম্পানি জনসন অ্যান্ড জনসনের বেবি পাউডার ব্যবহার করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এক নারীর মৃত্যুর ঘটনাটি প্রমাণিত হওয়ার পর ঘটনাটি বিশ্বজুড়ে সবার নজরে আসে। জার্মান আদালত জনসনের এ ঘটনায় কোম্পানিটিকে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭০০ কোটি টাকা জরিমানা করেন।
কিন্তু এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই দেশের কারোরই।
বাংলাদেশ স্টান্ড্যার্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউটের (বিএসটিআই) উপ-পরিচালক রেজাউল হক বাংলানিউজকে বলেন, দেশে উৎপাদিত বা বিপণন হওয়া কোনো শিশুপণ্যেরই কোনো স্ট্যান্ডার্ড মান নেই। এ বিষয়ে আইন না থাকায় দেশে উৎপাদিত বা বিপণন হওয়া এসব পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ বা পরীক্ষার সুযোগও বিএসটিআই’র নেই।
তিনি বলেন, অবাক করা বিষয় হলো, বিএসটিআই বড়দের সব পণ্যেরই পরীক্ষা বা মান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এসব পণ্যের একটি সুনির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ডও আছে। কিন্তু শিশুরা এ ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছে। আমরা এ বিষয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।
বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব নাজনীন বেগম বাংলানিউজকে বলেন, আমদানি হওয়া পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ বন্দরে হয় কি-না তা আমার জানা নেই। তবে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কোনো পণ্য সম্পর্কে আগে থেকে কোনো তথ্য জানতে পারলে আমরা তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) জানাই।
আমদানি করা পণ্যের বিষয়ে এর বেশি কিছু জানেন না বলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি সেকশনের দায়িত্বে থাকা এ কর্মকর্তা মন্তব্য করেন। তিনি তদারকির দায় দেন ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের ওপর।
তবে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কেউই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। রাষ্ট্রীয় মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিএসটিআই এ মন্ত্রণালয়েরই আওতাধীন সংস্থা। দেশের ১৫৪ ধরনের পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করলেও সংস্থাটির নেই কোনো ধরনের শিশুপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির ক্ষমতা।
কনজ্যুমার্স অ্যসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) প্রেসিডেন্ট গোলাম রহমান বাংলানিউজকে বলেন, কেবল শিশুপণ্য কেনো, কোনো কিছুতেই যথাযথ তদারকি ও আইন প্রণয়নের আগ্রহ নেই রাষ্ট্রের। ঘুষ, অনিয়ম, তদবির আর তেলবাজির কাছে জিম্মি হয়ে গেছেন ভোক্তারা।
তিনি বলেন, এটা মানা কঠিন যে, একটা রাষ্ট্রের জন্মের ৪৫ বছর পার হয়ে গেলেও সেদেশে এক শ্রেণীর পন্যের স্ট্যান্ডার্ড তৈরি হয়নি। আর সেই দোহাই দিয়ে মান নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রীয় সংস্থাটিও বিষয়টি এতোদিন অবহেলা করে গেলো। এটা এদেশের শিশুদের প্রতি রাষ্ট্রের এক ধরনের সন্ত্রাস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু সারা শামসুর রউফ বাংলানিউজকে বলেন, এ দেশে সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় অবহেলার শিকার শিশুরাই। এটাকে শুধু শিশুদের প্রতি রাষ্ট্রের সন্ত্রাস বললে ঠিক হবে না, এটা রাষ্ট্রের আত্মহত্যামূলক অবহেলা।
তিনি বলেন, এদেশে কেবল প্রসাধনই নয়, সকল প্রকার শিশুখাদ্য ও অন্যান্য ব্যবহার্য পণ্য কোনো ধরনের মান নিয়ন্ত্রণ এবং তদারকি ছাড়াই বাজারজাত করা হচ্ছে। দেশের অলি-গলি থেকে নামি-দামি কোম্পানি যেমন কোনো তদারকি ছাড়াই শিশুপণ্য তৈরি করছে, তেমনি বিদেশ থেকে কোনা যাচাই-বাছাই ছাড়াই শিশুখাদ্য, শিশু প্রসাধন, ডায়াপার ও শিশুদের ব্যবহার্য পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সবাই দেশে এ সংক্রান্ত আইন না থাকাকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে।
তিনি বলেন, এদেশে কেউই নিজে থেকে শুরু করেন না। যখন বিপদ আসে, তখন সবাই এটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিএসটিআই’র মান পরীক্ষার ক্ষমতা নেই। কারণ, ১০ হাজারের বেশি পণ্যের মধ্যে মাত্র ১৫৪টি তদারকির ক্ষমতা তাদের আছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রথমে দরকার সংস্থাটিকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে মুক্ত করা। কেউই এ মূল বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন না।
তিনি বলেন, আমি দীর্ঘদিন বিএসটিআই’র সঙ্গে কাজ করে দেখেছি, প্রতিষ্ঠানটির আয় ও ক্ষমতার অভাব নেই। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের অধীনে গিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন নষ্ট হয়েছে, বিএসটিআই’র অবস্থাও তাই। মন্ত্রণালয় থেকে একজন মহাপরিচালক আসেন, তিনি প্রতিষ্ঠানের কাজ সম্পর্কে ধারণা নিতে নিতে সময় পার হয়ে যায়। আবার মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকায় সরকারি সুপরিশ তামিলেই মহাপরিচালকের সময় যায়। ফলে কাজের কাজ কিছুই হয়না।
তিনি বলেন, দেশের ভোক্তা স্বার্থে বিএসটিআইকে প্রথমে মন্ত্রণালয়ের বাইরে আনতে হবে। একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের লোকবল গড়ে তুলেতে হবে। বাইরের মহাপরিচালক নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। তবেই না প্রতিষ্ঠানটি জনস্বার্থ রক্ষা করতে পারবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৬
আরএম/এএসআর