সিরাজগঞ্জ: বছরের বেশিরভাগ সময়ই অনেকটা বসে ও অলস সময় কাটাতে হয় সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার তাঁতপল্লীর কারিগর, বিশেষ করে শাড়ি তৈরির শ্রমিকদের। আবার কাজ থাকলেও চাহিদা ও কদর নেই আগের মতো।
তবে ব্যতিক্রম বাঙালির চিরায়ত উৎসব পহেলা বৈশাখের আগের প্রায় পুরোটা মাস। এ সময়টা সিরাজগঞ্জের তাঁতপল্লীগুলোতে নিয়ে আসে চরম ব্যস্ততা।
কাজের চাপে অবস্থা এমন হয়ে ওঠে যে, ঠিকমতো নাওয়া-খাওয়া ও ঘুমাবারও ফুসরত থাকে না শাড়ি তৈরির কারিগরদের। ফলে অতিরিক্ত মৌসুমী শ্রমিকদের ব্যবস্থা করতে হয়।
এবারও আসন্ন পহেলা বৈশাখ ঘিরে তুমুল ব্যবস্থায় সময় যাচ্ছে তাঁতিদের। সম্প্রতি জেলা সদরের সয়দাবাদ, রান্ধুনীবাড়ী, মাইঝাইল, মুলিবাড়ী; শাহজাদপুর উপজেলার খুকনী; বেলকুচি উপজেলার বেতিল, সোহাগপুর, চন্দনগাঁতী এবং উল্লাপাড়া ও কামারখন্দ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে খোঁজ নিয়ে ও ঘুরে এমনই চিত্র পাওয়া গেল।
সরেজমিনে কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেল, অধিকাংশ জায়গাতেই সবাই ব্যস্ত বৈশাখের শাড়ি তৈরির কাজে।
বৈশাখের আবহের কারণে এসব শাড়িতে ঢাক-ঢোল, একতারা-দোতারা, কলসি, ঘুড়ি, নৌকা, হাতপাখা, ইলিশ মাছ, মাছ ধরার পলো প্রভৃতি ছবির ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে।
এ কাজে তাঁত শ্রমিক ও কর্মচারীদের পাশাপাশি বাড়ির বউ, ছেলে-মেয়েরাও বসে নেই। কাপড় তৈরিতে ব্যস্ততম এ সময়ে তারাও সাধ্যানুযায়ী সহায়তা করছেন।
সয়দাবাদের শামছুল আলম, লাবু খান, আব্দুল হান্নান, লেবু খান ও শাহ আলমসহ বৈশাখী শাড়ি তৈরির ব্যবসায়ীরা জানান, শাড়ি তৈরির জন্য তারা নরসিংদীর বাবুরহাট এলাকা থেকে গজ হিসেবে সাদা কাপড় কিনে আনেন। পরে ওই কাপড়ে প্রিন্টিংয়ের কাজ করে বাজারে তোলেন। তবে শাড়িতে চাহিদা অনুযায়ী ডুগি-তবলা, ঢোল, একতারা-দোতারা, মাছ ধরার পলো, ইলিশ মাছ, কাঁঠাল, শাপলা ফুল নানা চিত্র ও নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়।
তারা জানান, পহেলা বৈশাখের মৌসুমে স্থানীয় নারী ও পুরুষ শ্রমিক ছাড়াও নিজ বাড়ির লোকজনকে দিয়েও কাজ করান তারা।
মাইঝাইলের নারী শ্রমিক মর্জিনা, রোজিনা, খাদিজা ও তাসলিমা বলেন, পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে তারা এক থেকে দেড় মাস কাজ করে বাড়তি আয় করতে পারি। এজন্য দিনপ্রতি তাদের দুই থেকে তিনশ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক দেওয়া হয়।
এক বাড়িতে দেখা গেলো, কিশোরদেরও কাজ করতে। জানা গেল স্কুলছাত্র উজ্জল কুমার, সঞ্জয় কুমার স্কুল ছুটি শেষে বাড়তি আয়ের উদ্দেশে রঙ করা শাড়ি ভাঁজের কাজ করছে। তাদের মতো অনেকেই এখন এ কাজ করছে।
সবুজ আলী নামে এক শ্রমিক জানান, শাড়ির ব্যাপক চাহিদা থাকায় তারা সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করছেন।
বৈশাখের শাড়ি ও তাঁত ব্যবসায়ী লাবু খান বলেন, মার্চ মাসের শুরু থেকে পহেলা বৈশাখের আগের রাত পর্যন্তও চলে প্রিন্টিংয়ের কাজ। ঢাকার গাউছিয়া, ইসলামপুর, টাঙ্গাইলের করটিয়া, পঞ্চগড়ের আটোয়ারী, পাবনার আতাইকুলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা এসে তার কারখানার শাড়ি নিয়ে যান।
তিনি জানান, বর্তমানে বাজারে বৈশাখী শাড়ির ব্যাপক চাহিদা থাকায় সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে ব্যবসায়ীরা বাড়িতেও এসেও যথেষ্ট শাড়ি পাচ্ছেন না।
অপর তাঁত ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নান মাস্টার বলেন, এখানকার একেকজন ব্যবসায়ীরা গড়ে দিনে আটশ থেকে এক হাজার পিস পর্যন্ত শাড়ি প্রিন্ট করেন। শ্রমিকদের বেতন, রঙ ও অন্যান্য খরচ শেষে শাড়ি প্রতি চার/পাঁচ টাকার মতো লাভ হয়। এভাবে এ সময়টাকে একজন ব্যবসায়ী এক থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন।
পঞ্চগড়ের আটোয়ারী থেকে বৈশাখের শাড়ি কিনতে এসেছেন কার্ত্তিক চন্দ্র সরকার নামে এক ব্যবসায়ী। তিনি জানান, বৈশাখী শাড়ির প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বৃষ্টির কারণে তাঁতিরা পর্যাপ্ত কাপড় তৈরি করতে পারেনি। এ তিনি এক হাজার পিস কাপড় নিতে এসেছিলেন, পেয়েছেন মাত্র দুইশ পিস।
ঢাকা থেকে শাড়ি নিতে আসা ব্যবসায়ী বিপ্লব সরকার, বেলকুচির ইসমাইল ও গাউসিয়ার ব্যবসায়ী বাবুল শেখও চাহিদা অনুযায়ী শাড়ি কিনতে পারেননি। ফলে বাধ্য হয়ে বেশি দামেই শাড়ি কিনতে হচ্ছে তাদের।
এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ভাইস প্রেসিডেন্ট সাঈদুর রহমান বাচ্চু বাংলানিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পহেলা বৈশাখকে ঘিরে সিরাজগঞ্জের তাঁতিরা শাড়ি প্রিন্টিংয়ের কাজ করছেন। তাঁতশিল্পের মন্দার বাজারে এ সময়ে তারা ব্যবসা ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বৈশাখী শাড়ি তৈরির কাজে তাঁতিরা আরও এগিয়ে যাবেন বলে তার মত।
সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ডা. জহুরুল হক রাজা বাংলানিউজকে বলেন, বাঙালির সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখকে আরো রঙিন করে তুলছেন সিরাজগঞ্জের তাঁতিরা। এটা বাঙালি সংস্কৃতির পাশাপাশি সিরাজগঞ্জের অর্থনীতির জন্যও অত্যন্ত ইতিবাচক।
বাংলাদেশ সময়: ০০৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৬
এসআর