ঢাকা: কলকারখানায় শ্রমিক নিরাপত্তায় সমন্বিত উদ্যেগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আগামীতে রানা প্লাজার মতো ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেজন্যই প্রয়োজন সকল চিত্র সামনে এনে একটা বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা করা।
‘বহুপাক্ষিক সংলাপ: রানা প্লাজা ধসের তিন বছর ও পোশাক শিল্পের অগ্রগতি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ মতামত দিয়েছে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ। শনিবার (১৬ এপ্রিল) রাজধানীর ব্র্যাক-ইন সেন্টারে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবিরের সঞ্চালনায় প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক ছিলেন মানবাধিকারকর্মী ড. হামিদা হোসেন, কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের ইন্সপেক্টর জেনারেল সাইদ আহমেদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক খন্দকার মোয়াজ্জেম হোসেন, ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) প্রকল্প ব্যবস্থাপক টপো পুটিয়ানেন, পোশাক খাতের উন্নয়নে গঠিত মার্কিন ক্রেতাদের সংগঠন ‘অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেসবাহ রবিন।
এছাড়া রানা প্লাজার ভুক্তভোগী শ্রমিক রফিক খান ও নাজমা আক্তার আলোচনায় অংশ নেন। গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন অ্যাকশনএইডের রাইট টু জাস্ট অ্যান্ড ডেমোক্রেটিক গর্ভনেন্সের (এএবি) ম্যানেজার নুজহাত জেবিন।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, রানা প্লাজা ধসের তৃতীয় বছরে এসে শ্রমিকদের অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে আহত শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তা দ্রুত না পাওয়ায় সেভাবে কাজে আসেনি।
রানা প্লাজার আহত ১৩০০ জন এবং নিহত ৫০০ জন শ্রমিকের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগেরই বয়স ২১ থেকে ৩০ বছর।
গবেষণায় বলা হয়েছে, রানা প্লাজায় আহত শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। আহত শ্রমিকদের মধ্যে ২০১৪ সালে ৯ শতাংশ শ্রমিকের অবস্থা খারাপ ছিল আর ১ দশমিক ৫ শতাংশের অবস্থা ছিল গুরুতর। ২০১৫ সালে ১৪১৪ জন আহত শ্রমিকের মধ্যে থেকে প্রায় ৭০ শতাংশের অবস্থা ভালোর দিকে। আর ২২ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন, তাদের শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। ২০১৬ সালে এসে ৭৮ দশমিক ৮ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন, তাদের শারীরিক অবস্থা ভালো। আর ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমিক বলেছেন, তাদের এখনো বেশ কিছু শারীরিক সমস্যা রয়েছে।
গবেষণায় আরো বলা হয়, তিন বছরের জরিপ থেকে প্রতীয়মান হয়েছে যে, আহত শ্রমিকদের কাজে ফেরার হার ক্রমবর্ধমান। একই সঙ্গে বেকারত্বের হার এই তিন বছরে ক্রমশ কমে যাচ্ছে। সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, আহত শ্রমিকদের ৫২ শতাংশ কোনো চাকরি বা স্বকর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, ৪৮ শতাংশ এখনও বেকার। যারা এই মুহূর্তে কাজে যুক্ত না, তাদের বেশিরভাগই সাময়িকভাবে বেকার।
ফারাহ কবির বলেন, আমাদের আইন আছে। কিন্তু তার প্রয়োগ নেই, বাস্তবায়ন নেই। রানা প্লাজা ধস হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু সংশ্লিষ্ট সবার সম্পূর্ণ ফেইলরের (ব্যর্থতা) কারণেই ঘটেছে। যার যেখানে যে দায়িত্ব ছিল তিনি তা পরিপূর্ণভাবে পালন করেননি। তাই এমন ঘটনা ঘটেছে। তাই আমাদের সকল চিত্র সামনে এনে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের ইন্সপেক্টর জেনারেল সাইদ আহমেদ বলেন, আমরা প্রতিটি কারখানা পরিদর্শনের চেষ্টা করছি। এই ৪ হাজার ৮০৮টি কারখানার মধ্যে এখন পর্যন্ত ৮০০টি কারখানার তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে। তবে সব খুঁটিনাটি তথ্য এখনও আমরা সংগ্রহ করতে পারিনি। তবে আমাদের চেষ্টা অব্যহত রযেছে। কারখানায় শ্রমিক নিরাপত্তার ব্যপারে কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না বলেও জানান তিনি। এই মুহূর্তে ৪৮১টি কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে।
সিপিডি’র গবেষক খন্দকার মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, রানা প্লাজার পর অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু আহত শ্রমিকদের সবার অবস্থা এক নয়। আহত শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকির যে সহায়তা দেওয়া হয়েছে তা পূর্ণাঙ্গ নয়। শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থা ও সরকারি সংস্থার মধ্যে নেওয়া প্রকল্পের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে বলে মনে করেন এই গবেষক।
তিনি বলেন, শ্রমিক নিরাপত্তার ইস্যুতে সমন্বিত উদ্যেগ দরকার। আহত শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবায় একটি বিশেষ ‘স্বাস্থ্যকার্ড’ প্রদান করা যেতে পারে, যেন ওই শ্রমিক সকল সরকারি হাসপাতালে কার্ড দেখিয়ে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারেন। এ কাজটি সরকারি দফতর থেকে উদ্যোগ নিলে ভালো হয়।
অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেসবাহ রবিন বলেন, আমাদের মেয়াদ ২০১৮ সালের ১১ জুলাই পর্যন্ত। এরপর আর একদিনও আমরা থাকবো না। কিন্তু অন্য যেসব সংস্থা কাজ করছে, তাদের ওপর বিদেশি ক্রেতাদের কতোটুক আস্থা রয়েছে সেটি ভেবে দেখা দরকার। তা না হলে ২০১৮ সালের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) সেক্টরে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
তিনি বলেন, আমরা সকল কারখানাকে সাতদিন সময় দিয়েছি। এ সাতদিনের মধ্যে সমস্ত কেচি গেট বা কলাপসিবল গেট তুলে দিতে হবে। তা না হলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দেবো। কেননা, যতোগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, কলাপসিবল গেট বন্ধ থাকার কারণে কেউ বের হতে পারেননি। ফলে বহু শ্রমিককে জীবন দিতে হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৬
এসএম/এএসআর