ঢাকা, সোমবার, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩১, ২৯ জুলাই ২০২৪, ২২ মহররম ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

আমদানির পরও কেজিতে এক টাকা বেড়েছে চালের দাম

গৌতম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৮ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০২১
আমদানির পরও কেজিতে এক টাকা বেড়েছে চালের দাম চাল। ছবি: জিএম মুজিবুর

ঢাকা: দেশের নিয়ন্ত্রণহীন চালের বাজারে লাগাম টানতে আমদানির অনুমতি দিয়েছিল সরকার। এতে কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা কমে দাম।

কিন্তু চাল আমদানির আবেদনের শেষ তারিখ ছিল ২৫ আগস্ট। এরপর আর আবেদনের অনুমতি না দেওয়ায় সোমবার (৩০ আগস্ট) ফের কেজিতে এক টাকা বেড়েছে সব ধরনের চালের দাম।  

এদিকে বেঁচে থাকার জন্য জরুরি এ খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ক্রেতারা। তবে, এ দাম বাড়াকে অস্বাভাবিক মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।  

তারা বলেন, চালের দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বাড়িয়েছে। এ অস্থিরতা রোধে বাজার নিয়ন্ত্রণে মিল মালিকদের ওপর নজরদারিতে গুরুত্বারোপ করেছেন তারা।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানা গেছে, এ পর্যন্ত ৭ দফায় মোট সাড়ে ১৬ লাখ মেট্রিক টন সিদ্ধ ও আতপ চাল আমদানির জন্য চার শতাধিক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তাদের আগামী ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে চাল আমদানি করে তা বাজারে বিক্রি করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম স্থানীয় বাজারের চেয়ে কম। চাল আমদানি করা হলে তা ব্যবসায়ীদের জন্য সুবিধাজনক হবে। এতে কৃষকের কোনো উপকার হবে না। সরকারকে এই বিষয়টির ওপর নজর দিতে হবে। আপাতত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে দেশে চাল উৎপাদনের খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। এ কারণে সরকারের উচিত কৃষকদের ভর্তুকি দেওয়া। এ ধরনের উদ্যোগ না নেওয়া হলে স্থানীয় কৃষক ও ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা হবে না।

সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরায় জাত ও মানভেদে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬২ টাকায়, নাজিরশাইল ৬০ থেকে ৬৪ টাকা, পাইজাম ৪৬ থেকে ৪৮ ও লতা ৫৫-৫৬ টাকা। এছাড়া বিরি-২৮ চাল ৫০ থেকে ৫২ টাকা এবং স্বর্ণা ৪১ থেকে ৪৩ টাকায়। এসব চাল একদিন আগেও এক টাকা কমে বিক্রি হয়েছে। আর ১৫ আগে ৩ টাকা বেশি দামে বিক্রি হয়েছিল।

পাইকারী বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট মানভেদে ৫৩, ৫৬,৫৯ টাকা। যা একদিন আগেও বিক্রি হয়েছে ৫২,৫৫,৫৮ টাকা। আর গত ১৫ দিন আগেছিলো ৫৫, ৫৮, ৬১ টাকা। নাজিরশাইল ৫৭, ৬০ ও ৬২ টাকা। একদিন আগে এক টাকা কমে বিক্রি হয়েছে। আর ১৫ দিন আগে ছিল ৬০, ৬৩, ৬৫ টাকা। ২৮ চাল প্রতিকেজি ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা, হাস্কী নাজির ৪৬, ৪৭, ৫০ টাকা। কাজল লতা ৫২ থেকে ৫৩ টাকা। পাইজাম ৪৩ থেকে ৪৪ টাকা। যা একদিন আগে বিক্রি হয়েছে এক টাকা কমে। ১৫ দিন আগে ছিলে এর থেকেও কেজিতে ৩ টাকা বেশি।

জানা গেছে, এ বছর বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন পেয়েছেন কৃষক। আনুমানিক প্রায় দুই কোটি টনেরও বেশি ধান কাটা হয়েছে। তবুও চালের দাম কমেনি। বোরো মৌসুমের আগে সরকারের মজুত সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছানোর নতুন রেকর্ড তৈরি হয়। এর ফলশ্রুতিতে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম বেড়ে ৫২ টাকা হয়ে যায়।

সরকার স্থানীয় বাজার থেকে নয় দশমিক ৩২ টন বোরো ও তিন দশমিক ৫০ লাখ টন অন্যান্য জাতের চাল সংগ্রহ করে মজুত বাড়ালেও বাজারে দাম আর কমেনি। গত ২৪ আগস্ট পর্যন্ত সরকারের হাতে সর্বমোট খাদ্য মজুত ছিল ১৭ দশমিক ২৫ লাখ টন। এর মধ্যে ১৪ দশমিক নয় লাখ টন চাল এবং বাকিটা ধান, গম ও আটা। গত বছর আগস্টের শেষ নাগাদ সর্বমোট খাদ্য মজুত ছিল ১৩ দশমিক ১৪ লাখ টন, এর মধ্যে নয় দশমিক ৮৫ লাখ টন চাল ছিল।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, আমরা আশাবাদী যে, দাম আরও কমে আসবে। আমরা আমন মৌসুমে ধান কাটার আগেই আমদানি প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেব, যাতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

এ বিষয়ে বাবুবাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির সেক্রেটারি নিজাম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, আমদানির খবরে চালের দাম বস্তায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কমেছে। তবে আমদানির আবেদনের তারিখ শেষ হয়েছে ২৫ আগস্ট। এরপর আর কোন আবেদন দেওয়া হয়নি। ফলে ব্যবসায়ীরা ভেবেছে আর চাল আমদানি করা হবে না। এছাড়া আমদানিকৃত চাল একটু ধীরগতিতে বাজারে প্রবেশ করেছে। এই আমদানি করা চাল যখন পুরোপুরি বাজারে চলে আসবে তখন দাম আরও কমে যাবে।  

বাবুবাজারের পাইকারী আড়তের রশিদ রাইস এজেন্সির আব্দুল রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, এখন চালের ভরা মৌসুমে দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। তারপরও দাম বাড়ছে। মূলত অসাধু ব্যবসায়ী ও মিলাররা কারসাজি করে চালের দাম বাড়িয়েছে। তারা ধান কিনে মজুদ করে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকার যখন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে তখন চালের দাম প্রকার ভেদে বস্তায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কমিয়ে দেয়। এখন এলসি করার তারিখ শেষ হওয়ায় আজ (৩০ আগস্ট) আবার চালের দাম বস্তায় ৫০ থেকে ৬০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ফলে কেজিতে ২/৩ টাকা কমলেও ১৫ দিনের ব্যবধানে চালের দাম আবার ১ টাকা বেড়েছে।  

বাবুবাজারের পাইকারী বাজারের দয়াল ভাণ্ডারের ম্যানেজার আনিসুল হক বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে চালের মৌসুম, তারপরও চালের দাম চড়া। এ সময় চালের দাম এতো হওয়ার কথা না। উৎপাদনও অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি হয়েছে। মূলত মিলাররা কারসাজি করে চালের দাম বাড়িয়েছে। আমদানির খবরে চালের দাম একটু কমলেও আজ থেকে আবার বাড়তির দিকে। আজ বস্তায় ৫০ টাকা বেড়েছে। সরকারের দুর্বল মনিটরিংয়ের কারণে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিচ্ছে। সরকারকে মনিটরিং ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে।

রায়সাহেব বাজারে খুচরা চালের ব্যবসায়ী মুক্তার হোসেন বলেন, গত এক সপ্তাহে দাম কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা কমেছিল। কিন্তু সোমবার থেকে আবার কেজিতে ১ টাকা করে বেড়েছে।  

এ প্রসঙ্গে সূত্রাপুর বাজারের চাল বিক্রেতা মো. আনিস ও আবুবক্কর বাংলানিউজকে জানান, চাল আমদানির ফলে গত দুই সপ্তাহে দাম কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা কমেছে। কিন্তু সোমবার থেকে আবার এক টাকা করে বেড়েছে চালের দাম। মিল মালিকরা দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় পাইকারিতে দাম বাড়ছে। আর এ কারণেই খুচরা বিক্রেতাদের বেশি দাম দিয়ে চাল কিনতে হচ্ছে এবং বিক্রি করতে হচ্ছে।

বাজারে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী দিপু রায়হান বলেন, প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে জীবনযাপন করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। একটি পণ্য কিনলে আরেকটি কেনার বাজেট থাকছে না। সরকারি নজরদারি বা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতার জন্য ব্যবসায়ীরা দফায় দফায় দাম বাড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিংয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।  

এদিকে গত ১৬ আগস্ট সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, চাল আমদানিতে ট্যাক্স সাড়ে ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। আশা করি আমদানির সব চাল এসে ঢুকলে তখন এর প্রভাব পড়বে, দাম কমবে। যারা ধান বা চাল মজুত করে রেখেছে তারা সেগুলো বাজারে ছেড়ে দেবে।

চাল আমদানি শুল্ক কমানোর এসআরও জারির পরই নওগাঁতে প্রতি বস্তায় চালের দাম ১০০ টাকা করে কমে গেছে। ধানের বাজার ৭০ টাকা কমেছে। এখানে কমবে না কেন যোগ করেন তিনি।

মন্ত্রী বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরকার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে। কেউ যদি মজুত রাখে স্পেশাল পাওয়ারে মামলার জন্য নির্দেশ দেওয়া আছে। আমাদের কাছে তো ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার সেটা করবে তো প্রশাসন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষক অধিদপ্তরও মামলা করতে পারবে। একইসঙ্গে নিয়ম না মানা মিল মালিকদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে গত ১২ আগস্ট চাল আমদানির শুল্ক কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। এই সুবিধা আগামী ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত বহাল থাকবে। এরপর চাল আমদানিতে আগ্রহী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আবেদন আহ্বান করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। বরাদ্দ আদেশ জারির ১৫ দিনের মধ্যে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট-ঋণপত্র) খুলতে হবে। বরাদ্দ পাওয়া আমদানিকারকদের ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুরো চাল বাংলাদেশে বাজারজাতকরণ করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যাংকে এলসি খুলতে ব্যর্থ হলে বরাদ্দ বাতিল হয়ে যাবে বলেও শর্ত দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৮ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০২১
জিসিজি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।