ঢাকা, শনিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

ঈদের আধুনিক ফ্যাশনে নতুনত্ব এনেছে ঐতিহ্যের রেশম

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২২
ঈদের আধুনিক ফ্যাশনে নতুনত্ব এনেছে ঐতিহ্যের রেশম ক্রেতাকে শাড়ি দেখাচ্ছেন এক বিক্রেতা। ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: আগের সেই জৌলুশ না থাকলেও আজও রাজশাহী পরিচিত হয় ‘রেশম নগরী’ হিসেবেই। করোনার ধকল কাটিয়ে প্রায় দুই বছর পর তাই আবারও প্রাণ ফিরে পেয়েছে রাজশাহীর ঐতিহ্য বহন করে টিকে থাকা রেশমপল্লি।

যুগ-যুগান্তর থেকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের রুচি ও ফ্যাশন নিত্যনতুন বদলাচ্ছে। কিন্তু এত ফ্যাশনের ভিড়ে আজও অমলিন রেশমের ঐতিহ্য। হাজার পণ্যের মধ্যেও বাঙালি সংস্কৃতিতে রেশমের আভিজাত্য এক রত্তিও কমেনি। বছরের অন্য সময় তো বটেই; ঈদ-পরবে তো কথাই নেই। রেশমি পোশাক যেন চাই-ই চাই। আর যখনই কোথাও রেশমের কথা উঠবে। তখনই মনে পড়বে উত্তরের শহর রাজশাহীর নাম।  

করোনা কাটিয়ে রেশমপল্লিতে এবার ঈদের চিরচেনা সেই আনন্দ-অনুভূতি আবার ফুটে উঠেছে আপন মহিমায়। গেল দুই বছর রোগ-শোক আর মৃত্যুর রঙে যেন ধূসর হয়ে উঠেছিল ঈদের আনন্দ। কিন্তু এবার ঈদের শুরু থেকে শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীসহ সব বরয়ের মানুষের কলকাকলীতে আবারও উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে রাজশাহীর রেশমপল্লি। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গড়িয়েছে ঈদের কেনাকাটা। কোনো কোনো শো-রুম রাত ১টা পর্যন্ত খোলা থাকছে এখনই। তাই সবমিলিয়ে আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে রাজশাহীর রেশমপল্লিতে। রাজশাহীতে উৎসব-পার্বণে রেশম পণ্যে চাহিদা এখনও আকাশচুম্বী। সারা দেশ তথা গোটা বিশ্বে প্রসিদ্ধ রাজশাহী সিল্কের ব্যবসা। তাই ঈদের মৌসুমে রাজশাহীর রেশমপল্লিতে এখন পা রাখার জায়গা নেই। ক্রেতাদের সরব উপস্থিতিতে দুই বছরের লোকসানের কাটিয়ে তাই আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন বুনছেন রেশমশিল্প মালিকরা। মালিক, শ্রমিক-কর্মচারী সবার মুখেই তাই হাসি ফুটেছে এবার। আদি পেশা ও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে রেশমপল্লির ব্যবসায়ীরা টিকে থাকার লড়াইয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন এত দিন।

রাজশাহীর রেশমপল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, শো-রুমগুলোতে রয়েছে চিরচেনা সেই উপচেপড়া ভিড়। প্রতিটি শো-রুমেই কেনাকাটা তুঙ্গে। কেউ পছন্দ করছে, কেউ দরদাম। সাধ ও সাধ্য অনুযায়ী নিজের ও পরিবারের জন্য একটু করো রেশম পণ্য কেনার চেষ্টা করছেন সবাই। প্রতিটি কারখানাতেই এখন কাজ চলছে জোরতালে। চারিদিকে যেন ঈদের আমেজ। এখানে সারাবছর রেশমের পোশাক তৈরি হলেও ঈদে এই চাহিদা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ঐতিহ্যের পরম্পরায় তাই রেশম ও রাজশাহী দুটি নামই বহন করছে একে অপরের পরিচিতি। তাই দিন-রাত এক করে কাজ করছেন সবাই। রেশমপল্লির পুরনো শ্রমিক জয়নাল হোসেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, একটা সময় ছিল যখন সারা বছরই রাজশাহীর বিসিক এলাকায় থাকা রেশম কারখানাগুলো সরগরম থাকতো। কিন্তু করোনার কারণে দুই বছর ব্যবসা হয়নি। চাপও কম ছিল। কিন্তু আবারও তাদের ব্যস্ততা বেড়েছে। চাহিদার যোগান দিতে এখন তারা আগের মত ওভারটাইম নিয়ে কাজ করছেন। শেষ দশকে যেন দম ফেলারও সুযোগ নেই রেশম কারখানার নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের। ক্রমবর্ধমান ক্রেতাদের চাহিদাকে মাথায় রেখে এখানে রমজানজুড়েই চলবে রেশমী কাপড় বুননের কাজ।
 
আর প্রতি বছরই রেশমের পোশাক ছাড়া যেনো ঈদের খুশিই মলিন হয়ে যায়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবার সামনে তাই শো-রুমগুলো হাজির করছে নিত্যনতুন রেশমী পোশাক। নানান রঙের থ্রি-পিস, রেশমী শাড়ি না হয় পাঞ্জাবি। ঈদে তাই রাজশাহীর মানুষ ঈদ ফ্যাশনে ছড়াতে চান রেশমের শুভ্রতা। রেশমের প্রতি রমণীদের বিশেষ টান যেমন নতুন কিছু নয়। তেমনি এমন অনেক পুরুষও রয়েছেন ঈদে যাদের রেশমের পাঞ্জাবি লাগবেই। এখনও রাজশাহীর মানুষ রেশম ছাড়া উৎসবের কথা ভাবতেই পারেন না।  রেশমপল্লির সবচেয়ে বড় শো-রুম হচ্ছে- সপুরা সিল্ক। সেখানে কেনকাটা করতে আসা এনজিও কর্মকর্তা ফারুক হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, রাজশাহীর মানুষের ঈদ আর সিল্ক যেন যুগ যুগ থেকে একই সুতোয় গাঁথা। তাই স্ত্রী ও মেয়েদের নিয়ে ঈদের শপিং করতে এছেন রেশমপল্লিতে। সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবারের পর শনিবারও সমান ভিড় রয়েছে রেশমের শো-রুমে। হাতে আর মাত্র কয়েকটি দিনই রয়েছে তাই শেষ মুহূর্তের কেনাকটায় পুরোদমে জমে উঠেছে রাজশাহীর সিল্ক হাউসগুলো। প্রতিটি পোশাকেই যেনো আলোর ঝিলিক। চোখ ধাঁধানো রঙ আর বাহারি ডিজাইনের অভিজাত রেশমী পোশাকের টানে আজ সকাল থেকেই সেখানে ছুটছেন সব বয়সের ক্রেতা। থরে থরে সাজানো হাজারো কাপড়ের ভিড়ে নিজের ও পরিবারের প্রিয় মানুষগুলোর জন্য স্বতন্ত্র ও সেরা পোশাকটি পরখ করে নিচ্ছেন তারা। রেশমের মুগ্ধতায় অনেক তরুণী কোনটা রেখে ঠিক কোনটা নেবেন ধন্ধে পড়ে যাচ্ছেন। সাহায্য নিচ্ছেন স্বজনদের।

সপুরা সিল্কের শো-রুমে ঈদের কেনাকাটা করতে এসেছিলেন মহানগরীর নিউমার্কেট এলাকার গৃহীনী ফারজানা শিশির। তিনি বলেন, তার ও তার শাশুড়ির জন্য রেশমের শাড়ি এবং স্বামীর জন্য রেশমের পাঞ্জাবি কিনতে এসেছেন। একই ছাদের নিচে রয়েছে সন্তানের পোশাকও। রাজশাহী সিল্ক দেশজুড়ে সমৃদ্ধ। তাই ঈদে তার পরিবারের পছন্দের তালিকায় রেশমী পোশাকের কদরই বেশি বলে জানান শিশির।

শো-রুমটি ঘুরে দেখা গেছে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে এবার বিপুল রেশম পণ্যের সমাহার ঘটিয়েছেন তারা। সুই-সুতা কাতান, বলাকা কারচুপি, কোটি সিল্ক, জয়শ্রী, সিল্ক কাতান, এনডি, থ্রি স্টার কাতান, ওয়াটার কাতান, জামদানি কাতান, র-কাতান, দুপিয়ানা, ঝরনা কাতান, কারুচুপিসহ হরেক নামের শাড়ি-কাপড়, থ্রি-পিস, ওড়না, পাঞ্জাবি-পায়জামা, শার্ট, ফতুয়া, স্কার্প এবং টাই থরে থরে সাজানো রয়েছে সপুরা সিল্কের জাঁকালো ওই শো-রুমে। লাল, নীল, সবুজ, বেগুনি; বর্ণিল সব রঙের আলোয় সব সময় ঝলমল করছে শো-রুমে থাকা নতুন নতুন বাহারি ডিজাইনের রেশমী পোশাকগুলো। এখানে সিল্ক শাড়ি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮শ ৯৯ টাকা থেকে ২২ হাজার টাকার মধ্যে। পাঞ্জাবি রয়েছে ৮শ ৯৯ টাকা থেকে ৩ হাজার ৫শ টাকার মধ্যে। সিল্ক ছাড়াও সুতির পাঞ্জিাবি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকা থেকে ৪ হাজার টাকার মধ্যে। মসলিন সিল্ক রয়েছে ৫ হাজার ৫শ টাকা থেকে ১২ হাজার টাকার মধ্যে। মটকা সিল্ক রয়েছে ৩ হাজার টাকা থেকে ৬ হাজার ৫শ টাকার মধ্যে। থ্রি-পিস রয়েছে ২ হাজার টাকা থেকে ৪ হাজার টাকায়। সিল্কের শার্ট রয়েছে ৭শ থেকে ১ হাজার ৬শ ৫০ টাকার মধ্যে। ফুলহাতা ও হাফহাতা ডিজাইনের বিভিন্ন রঙের ফতুয়া রয়েছে সাড়ে ৫শ থেকে ১ হাজার ৮শ টাকার মধ্যে। সুতি শার্ট রয়েছে ৮শ থেকে ২ হাজার টাকার মধ্যে। কাটোয়ার ডিজাইনের শাড়ি, সফট সিল্ক শাড়ি রয়েছে ১ হাজার ৬শ ৫০ থেকে সাত হাজার টাকার মধ্যে।  

এন্ডি সিল্ক রয়েছে ৩ হাজার ৭শ থেকে ৫ হাজার টাকায়। বলাকা সিল্ক রয়েছে ৪ হাজার ২শ থেকে ৫ হাজার টাকায়। র-মসলিন রয়েছে ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে। বলাকা স্টিজ শাড়ি রয়েছে ৬ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকার মধ্যে। এছাড়া রয়েছে পার্টি ড্রেস, কন্ট্রাস্ট থান শাড়ি, সুতি পোশাক, স্যান্ডেল ও জুতোসহ বাহারি সব পণ্যের সমারোহ। রাজশাহীর সপুরা শো-রুমের ব্যবস্থাপক সাইদুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, ঈদকে সামনে রেখে প্রতিদিনই নতুন নতুন আইটেম যোগ করছেন তারা। বিশেষ করে এবার গরম বেশি হলেও গ্রীষ্ম-বর্ষা সব ঋতুতেই পরার উপযোগী করে এবার বিভিন্ন ডিজাইনের মসলিন সিল্কের পোশাক তৈরি করা হয়েছে। তবে এবারের ঈদে বড় আকর্ষণ কাটোয়ার ডিজাইনের শাড়ি। আর আছে র-সিল্কের ওপর হাতের কারুকাজ। এ বছর ঈদে বেশি বিক্রি হচ্ছে ‘পার্টি ড্রেস’। এটি শিশু-কিশোরদের মধ্যে বেশ সারা ফেলেছে। এছাড়া তাদের শো-রুমে থাকা মসলিনের পাঞ্জাবি ও শাড়ির বিক্রি সবচেয়ে বেশি। পাঞ্জাবি ২ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত রয়েছে। থ্রি-পিস ৪ হাজার ৫শ টাকা থেকে শুরু করে ২০ হাজার এর ওপরেও রয়েছে। শাড়ি ২ হাজার ১৫০ থেকে শুরু করে ২৫ হাজার টাকার ওপরেও রয়েছে।

কেনাবেচা এখন জমজমাট। সবমিলিয়ে চাঁদ রাত পর্যন্ত বেচা-কেনা চলবে। এ সময় তাদের কারখানা ও শো-রুমের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দম ফেলার ফুরসত নেই বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২২
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।