সিরাজগঞ্জ: এক সময় তাঁতের খটখট শব্দে মুখরিত থাকতো সিরাজগঞ্জ ও এর আশপাশের অঞ্চল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় নানা কারণে সেই জৌলুস হারিয়ে গেছে।
এখন বন্ধ বেশিরভাগ তাঁত। জীবন-জীবিকার তাগিদে অনেকেই এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে আমাদের সিরাজগঞ্জ ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট স্বপন চন্দ্র দাসের দুই পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো আজ।
চল্লিশ বছরের তাঁত ব্যবসা ছেড়ে মুদি দোকান দিয়েছেন সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ছাতিয়ানতলী গ্রামের আবুল কালাম আজাদ। স্ত্রী ও তিন মেয়ে নিয়ে তার সংসার চলে মুদি দোকানের আয়ে। পাশাপাশি রয়েছে তিন মেয়ের পড়াশোনা। সব মিলিয়ে অতিকষ্টেই দিনাতিপাত করছেন এক সময়ের মধ্যম সারির এই তাঁত ব্যবসায়ী।
ষাটোর্ধ আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, ৪০ বছর ধরে তাতের ব্যবসা করেছি। আমার কারখানায় ১৬টি তাঁত ছিল। প্রায় ২০ জন শ্রমিক কাজ করতেন। সবসময় তাঁতের খটখট শব্দে মুখরিত থাকা বাড়িটিতে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। বেশ কয়েক বছর ধরেই সুতা ও রঙের দাম বাড়লেও বাড়ছিল না উৎপাদিত কাপড়ের দাম। বাজারে কাপড়ের চাহিদাও কমে যাচ্ছে। এসব কারণে একের পর এক লোকনান গুণতে হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয় করোনার আগ্রাসন। ফলে ধীরে ধীরে পুঁজি ফুরিয়ে যায়। এ কারণে বাধ্য হয়েই বছরখানেক আগে তাঁত কারখানা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছি। ফ্যাক্টরি ঘরের একটি অংশে মুদি দোকান দিয়ে কোনমতে জীবিকা নির্বাহ করছি। মেয়েদের পড়াশোনা ও সংসারের অভাব মেটাতে ৮টি তাঁত বিক্রি করেছি। এখন আর মাত্র ৮টি তাঁত আছে।
আবুল কালাম আজাদের ছোট ভাই আনিছুর রহমানেরও তাঁতের কারখানা ছিল। তিনিও সব তাঁত বিক্রি করে অন্যের কারখানায় ড্রাম মাস্টারের কাজ করছেন।
একই এলাকায় নিজের কারখানায় কাপড় বুনছিলেন মুকুল হোসেন নামে এক তাঁতী। তিনি নিজের কারখানার ৬টি তাঁতের মধ্যে ২টি বন্ধ করে দিয়েছেন। বাকি দুটির একটি নিজে চালাচ্ছেন, অপরটি দুই শ্রমিক দিয়ে চালাচ্ছেন।
সদর উপজেলার বাঐতারা গ্রামের হাতেম আলী, ওয়াহাব সরকার, ছাতিয়ানতলীর ছোয়াব আলী, বেলকুচির ভাতুরিয়া গ্রামের মঈন উদ্দিন ও শামীমসহ অনেকেই তাঁত ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। এছাড়াও এসব অঞ্চলের অনেক তাঁতী ঋণের বোঝা বইতে না পেরে ফ্যাক্টরি বিক্রি করে বাধ্য হয়ে এলাকা ছেড়েছেন।
এমন চিত্র সিরাজগঞ্জ সদর বেলকুচি, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলার তাঁতপল্লী খ্যাত এলাকাগুলোর।
ছাতিয়ানতলীর ব্যবসায়ী আনিছুর, শাহাদত হোসেন, রাজু আহমেদ, ছোয়াব আলী ও গোলাম আজম, বেলকুচির ভাতুরিয়ার মঈন উদ্দিন, মকিমপুরের রেজাউল করিমসহ তাঁতীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাঁত কাপড়ের ব্যবসা।
দফায় দফায় সুতা ও রঙের দাম বাড়লেও বাড়ছে না কাপড়ের দাম। ফলে লোকসান গুণতে হচ্ছে তাঁতীদের। পুঁজি হারিয়ে অনেকেই পথে বসেছেন। বন্ধ করে দিয়েছেন তাঁত কারখানা। অনেকে তাঁত বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা তাঁতের ব্যবসা কোনমতে টিকিয়ে রেখেছেন।
তাঁতীরা বলেন, দুই বছর আগে প্রতি ১০০ পাউন্ড সুতোর দাম ছিল সাড়ে ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকা। সেই সুতা এখন ২৩-২৫ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। আর তিন হাজার টাকা কেজির রঙ কিনতে হচ্ছে ৬ হাজার টাকায়। সিল্কের মূল্যও বেড়েছে প্রতি পাউন্ডে ৪০-৫০ টাকা। কাপড় উৎপাদনের এস পণ্যের দাম দিগুণ হলেও প্রতি পিস কাপড়ের দাম বেড়েছে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা। দুই বছর আগে যে কাপড়ের পাইকারী মূল্য ৫শ টাকা ছিল এখন তা সর্বোচ্চ ৫৫০ টাকা।
সয়দাবাদ পুনর্বাসন এলাকার ডায়িং কারখানার মালিক আশরাফুল ইসলাম বলেন, তাঁত বন্ধ হওয়ার কারণে সুতা ডায়িংয়ের কাজও অনেক কমে গেছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ডায়িং কারখানা। প্রায় দেড়শ তাঁতীর সুতো ডায়িং হতো আমার ফ্যাক্টরিতে। এদের অধিকাংশই তাঁত বন্ধ করে দেওয়ায় আমার ব্যবসা বন্ধ হওয়ার পথে।
বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম-পাওয়ারলুম ওনার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ন সম্পাদক ও সিরাজগঞ্জ জেলার সভাপতি বদিউজ্জামান বদি বলেন, ২০১৯ সালে জেলায় অন্তত সাড়ে তিন লাখ তাঁত ছিল। গত তিন বছরে এর শতকরা ৪০ ভাগ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় সোয়া লাখ তাঁত বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। এসব তাঁতীরা অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। তাঁতের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরাও অন্যসব দিনমজুরের পেশা বেছে নিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘন্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২২
এমএমজেড