ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

মানি লন্ডারিং-স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধে একসঙ্গে কাজ করবে বাজুস-বিএফআইইউ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০২২
মানি লন্ডারিং-স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধে একসঙ্গে কাজ করবে বাজুস-বিএফআইইউ

ঢাকা: মানি লন্ডারিং ও স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) একসঙ্গে কাজ করবে। বিষয়টি জানিয়েছেন বাজুসের প্রেসিডেন্ট সায়েম সোবহান আনভীর।

 

একইসঙ্গে তিনি স্বর্ণ চোরাচালান প্রতিরোধে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন।  

বৃহস্পতিবার (২৪ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন প্রতিরোধে বাজুসের সঙ্গে বিএফআইইউয়ের সভা শেষে সায়েম সোবহান আনভীর সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

বিএফআইইউয়ের প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাস সভায় সভাপতিত্ব করেন। বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও বাজুসের প্রেসিডেন্ট সায়েম সোবহান আনভীরের নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সভায় অংশ নেয়। এ ছাড়া সভায় বিএফআইইউয়ের উপ-প্রধান ও পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।


 
বাজুস প্রেসিডেন্ট সায়েম সোবহান আনভীর বলেন, অর্থ পাচার ও ডলার সংকটের নেপথ্যে রয়েছে সোনা চোরাচালান। অনেকে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। আইন থাকলেও যথাযথ প্রয়োগ নেই। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে সোনা চোরাকারবারিরা খালাস পাচ্ছেন। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে জামিন অযোগ্য মামলা দিতে হবে।

এ ছাড়া মানি লন্ডারিং ও স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে সর্বাত্মক সহায়তা দিতে যৌথভাবে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন কাজ করবে বলে জানান তিনি।  

এ বিষয়ে বিএফআইইউর প্রধান কর্মকর্তা বলেন, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়নের মতো আন্তর্জাতিক সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় অবস্থান রয়েছে। দুর্নীতি, মানিলন্ডারিং, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে।  

তিনি বাংলাদেশে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় সংস্থা হিসেবে বিএফআইইউর ভূমিকা সম্পর্কে অবহিত করেন।  

মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এ মূল্যবান ধাতু ও পাথর তথা স্বর্ণ চোরাচালানকে সম্পৃক্ত অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।  

তিনি বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানে জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের ঝুঁকি বিবেচনায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এ মূল্যবান ধাতু বা পাথরের ব্যবসায়ীকে বিএফআইইউয়ের রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা, ২০১৯-এ রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে মূল্যবান ধাতু ও পাথরের ব্যবসায়ীদের দায়-দায়িত্বের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনার পাশাপাশি তাদের সংগঠন বাজুসের ওপর বেশকিছু দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে।

বাজুসের সাবেক সভাপতি এনামুল হক খান সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আজ আলোচনা করেছি কীভাবে সোনা চোরাচালান ও মানি লন্ডারিং বন্ধ করা যায়। সে বিষয়ে মতবিনিময় করেছি। আমাদের আলোচনা সফল হয়েছে। আগামী দিনে একসঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমরা আমাদের মেম্বারদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ শুরু করব। এ বিষয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগে ও জেলায় বাজুস ও বিএফআইইউ যৌথভাবে সচেতনতা বৃদ্ধিতে একসঙ্গে কাজ করবে। চোরাচালান বন্ধে ভবিষ্যতেও বাজুস বাংলাদেশ ব্যাংককে সহযোগিতা করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক যে সোনা বিক্রি করবে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা বা বাজুস কিনবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগারওয়াল বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যে আজ স্বর্ণ নিলাম করছে, এর মূল অবদান বাজুসের। কারণ বাজুসের অনুরোধেই বাংলাদেশ ব্যাংক এটি শুরু করছে। আমরা আরও বলেছি বাংলাদেশ ব্যাংকের যত স্বর্ণ আছে, তা যেন তারা বেশি করে নিলাম করে।

তিনি বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে স্বর্ণ শিল্পের কাঁচামাল তেমন নেই। শিগগিরই আমাদের দেশে স্বর্ণ শিল্প হচ্ছে বা বসুন্ধরা রিফাইনারি হচ্ছে। আজ চোরাচালানের মাধ্যমে যে মানি লন্ডারিং হচ্ছে, তা অনেকাংশে কমবে। আমরা এটি বোঝাতে সক্ষম হয়েছি।

স্বর্ণ চোরাচালানের পরিমাণ কত-  জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংক বের করবে। আমরা কোনো পরিমাণ বলতে পারি না। কারণ আমরা কোনো এজেন্সি না। আমরা হলাম তাদের কো-পার্টনার। আগামী দিনে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাজুস একসঙ্গে কাজ করবে। আমরা ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করব। বাংলাদেশ জুয়েলারি অ্যাসোসিয়েশন প্রতিটি কাজে বাংলাদেশ ব্যাংক সহযোগিতা করবে। আমাদের ৪০ হাজার মেম্বার এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক কোটি লোক এই খাতের সঙ্গে জড়িত।  

একসঙ্গে আপনারা কী করতে চান- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা প্রথমে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, ক্রেতা সাধারণ, দোকানদার ও শোরুমের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে চাই।  

বাজুসের কোনো প্রতিষ্ঠান যদি স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে কোনো ব্যবস্থা নেবেন কি না- জানতে চাইলে দিলীপ কুমার আগারওয়াল বলেন, আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। এ বিষয়ে আজ আলোচনা হয়েছে। আমরা তাদের আশ্বস্ত করেছি। বাংলাদেশের কোনো জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে আছে বলে কোন সংস্থা প্রমাণ করতে পারেনি। যদি আগামীতে প্রমাণিত হয়, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
 
এ বিষয়ে পরিষ্কারভাবে জানতে চাইলে দিলীপ কুমার বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে জিজ্ঞেস করতে হবে, এর সঙ্গে কী ধরনের লেনদেন সম্পৃক্ত আছে। কী পরিমাণ আছে, সেটা তারাই বলতে পারবে। আমরা বর্তমান কমিটি ৭০০ মেম্বার থেকে ৪০ হাজার মেম্বারে নিয়ে এসেছি। একটি ডিজিটাল প্লাটফর্মের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে বাজুসকে। বিএফআইইউ আমাদের কাছে যে তথ্য চাইবে, আমরা সব তথ্য তাদের কাছে শেয়ার করব।  

স্বর্ণ চোরাচালান প্রতিরোধে বাজুসের প্রস্তাবনাগুলো হলো: 
১. সোনা চোরাচালান ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ এবং চোরাকারবারিদের চিহ্নিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাজুসের সমন্বয়ে যৌথ মনিটরিং সেল গঠন করা।  

২. চোরাকারবারিরা যাতে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে আরও কঠোর আইন প্রণয়ন করা।  

৩. স্বর্ণ চোরাচালান প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেমন বিজিবি, র‍্যাব ও পুলিশের জোরালো অভিযান নিশ্চিত করা।  

৪. চোরাচালান প্রতিরোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের সদস্যদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে উদ্ধার হওয়া স্বর্ণের মোট পরিমাণের ২৫ শতাংশ সংস্থাসমূহের সদস্যদের পুরস্কার হিসেবে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া।

৫. ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনার বার ও অলংকার আনার সুবিধা অপব্যবহারের কারণে ডলার সঙ্কট, চোরাচালান ও মানি লন্ডারিংয়ে কী প্রভাব পড়ছে, তা নিরূপণে বাজুসকে যুক্ত করে যৌথ সমীক্ষা পরিচালনা করা।  

৬. অবৈধ উপায়ে কোনো চোরাকারবারি যেন সোনার বার বা অলংকার দেশে আনতে এবং বিদেশে পাচার করতে না পারে, সে জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া।  

৭. জল, স্থল ও আকাশপথ ব্যবহার করে অবৈধ উপায়ে কেউ যাতে সোনার বার বা অলংকার আনতে না পারে, সেজন্য কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা নেওয়া।

উল্লেখ্য, জুয়েলারি শিল্পে স্বর্ণ চোরাচালান বড় ধরনের সঙ্কট ও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চোরাচালান শুধু দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে না। চোরাচালানের ফলে অর্থনৈতিক সঙ্কট বাড়ছে। ধারণা করা হয়, প্রবাসী শ্রমিকদের রক্ত-ঘামে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অপব্যবহার করে জল, স্থল ও আকাশপথে প্রতিদিন কমপক্ষে প্রায় ২০০ কোটি টাকার অবৈধ স্বর্ণ অলংকার ও বার চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসছে, যা ৩৬৫ দিন বা এক বছর শেষে দাঁড়ায় প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০২২
জিসিজি/জেডএ/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।