ঢাকা: সিরাজগঞ্জ সদরের রাজিবপুর মাদ্রাসায় ২০১০ সালে দাখিল পরীক্ষায় ২৫ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়ে সবাই পাস করে। জিপিএ-৫ পায় ৩ জন।
অভিযোগ আছে, প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করে রাজিবপুর মাদ্রাসা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা এমপিও’র তালিকাভুক্ত হয়। কিন্তু এর কিছু দিন পরেই শর্ত পূরণ না করলেও প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা উপদেষ্টার সুনজরের কারণে উপদেষ্টার করা তালিকায় জায়গা করে নেয় দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানটি। আর এই তালিকায় বাদ পড়া রাজিবপুর দাখিল মাদ্রাসা এখন পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হতে পারেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, অন্যান্য শর্তের মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত হতে হলে নূন্যতম ২০ জন পরীক্ষার্থী দাখিল কিংবা সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করতে হবে ৫০ শতাংশ। কিন্তু শর্ত পূরণ না করে শুধু্ উপদেষ্টার সুনজর এনে দেয় শ্যামপুর দাখিল মাদ্রাসার এমপিওভুক্তির সুযোগ। যদিও রাজিবপুর মাদ্রাসা এমপিও’র জন্য সুপারিশ ছিল স্থানীয় সংসদ সদস্য তানভীর শাকিল জয় ও পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার এমপি’র।
রাজিবপুর দাখিল মাদ্রাসার মতো অনেক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় সব শর্ত পূরণ করেও সরকারের সুনজরে না পড়ায় এমপিও’র সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ২০১০ সালের পর এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বেতন না পেয়েও শিক্ষার্থীদের পড়ান অভাব অনটনের মধ্যে।
এমনি আর একটি প্রতিষ্ঠান নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ রনচণ্ডি বসনিয়া বালিকা দাখিল মাদ্রাসা। ২০০৪ সালে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়ে প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করে ২০১০ সালে প্রথম দফায় এমপিওভুক্তির অর্ডার পায় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু পরের তালিকায় স্থানীয় সংসদ সদস্য কাজী ফারুকের সুপারিশে অনুমোদন আসে রনচণ্ডি শামসুল উলুম আলীম মাদ্রাসার। অবশ্য ৮ মাস তদন্ত শেষে এই মাদ্রাসার এমপিও বাতিল হয়ে যায়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ২৭ হাজার ৪২৬টি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের সংখ্যা ৫ লাখেরও বেশি। তাদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রতি বছরে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। এটা এ খাতের বরাদ্দের ৬০ শতাংশ। বর্তমান সরকারের আমলে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, ২০১০ সালের ৬ মে প্রথম দফায় শিক্ষামন্ত্রীর একটি তালিকার কিছু দিন পর প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা উপদেষ্টা এমপিও’র আর একটি তালিকা করেন। প্রথম তালিকা থেকে দ্বিতীয় তালিকায় বাদ পড়ে ৬১টি প্রতিষ্ঠান।
নন এমপিও শিক্ষকদের অভিযোগ, প্রয়োজনীয় শর্ত না থাকলেও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেবল রাজনৈতিক বিবেচনায় স্বীকৃতি এবং এমপিওভুক্ত হয়। অথচ শহর-গ্রামাঞ্চলের অনেক প্রতিষ্ঠান শর্ত থাকলেও এমপি-মন্ত্রীদের সুনজর না পেয়ে এমপিওভুক্ত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ফলে নিদারুণ কষ্টে আছে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী।
চলতি অর্থবছরের মধ্যে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত, স্বীকৃতির সময় থেকে চাকরির বয়স গণনা এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন না দেওয়ার দাবিতে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৪ হাজার ৪৮৪টি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন।
দাবির বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষাসচিবের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনায় বসেও কোনো আশ্বাস না আসায় ১ অক্টোবর থেকে তারা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। ৪ অক্টোবর সচিবালয় ঘেরাও করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত হন শিক্ষক-কর্মচারীরা। পরে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে বসার আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত তার সাক্ষাৎ পাননি। তবে তারা চেয়ে আছেন প্রধানমন্ত্রীর অপেক্ষায়।
এদিকে এমপিওভুক্ত না হওয়ায় বেতন-ভাতা না পেয়ে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা নিদারুণ কষ্টে দিন অতিবাহিত করছেন। অনেকে করেন মজুরির কাজ।
যশোর মনিপুর ইত্তা স্লুইচগেট মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক রুহুল কুদ্দুস বাস্তুভিটার ২০ কাঠার ১০ কাঠা বন্ধক রেখে সরকারি বেতনের আশায় খরচাপাতির জন্য টাকা দিয়েছিলেন মাদ্রাসায়। কিন্তু দীর্ঘ দিনেও বেতন না হওয়ায় তিন ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা এবং সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। বাধ্য হয়ে এখন ক্লাসের বাইরে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন পরের জমিতে।
সিরাজগঞ্জ রাজিবপুর দাখিল মাদ্রাসা সুপার মওলানা লাইস আহমেদ বাংলানিউজকে জানান, এমপিওভুক্তির নীতিমালার শর্ত পুরণ করে শিক্ষামন্ত্রীর করা এমপিওর তালিকায় (৬ মে, ২০১০, শা-১৩/এমপিও/১২/২০০৯/১৮৪) মাদ্রাসাটি স্থান পায়। কিন্তু কয়েক দিনের মাথায় প্রথম তালিকা বাতিল করে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা উপদেষ্টার করা তালিকায় অজ্ঞাত কারণে মাদ্রাসাটিকে বাদ দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, “২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার পর দাখিল-এবতেদায়ী-জেডেসি পরীক্ষায় তারা ভালো করছেন। বর্তমানে এখানে ৪১০ জন শিক্ষার্থী আছে। চলতি বছর ৪১ জন শিক্ষার্থী দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করে ৩৬ জন।
মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা এমএ খালেক বলেন, “এলাকার ছেলে-মেয়েরা আধুনিক শিক্ষা পাবে এমন ভাবনা থেকে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু এমপিও না হওয়ায় শিক্ষকরা বেতন-ভাতা না পেয়ে দু:খ-দুর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। ”
শিক্ষক-কর্মচারীদের কথা বিবেচনা করে প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্তির দাবি জানান তিনি।
শিক্ষক-কর্মচারীদের কষ্টের কথা স্বীকার করে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের সহ-সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ততার কারণে সময় দিতে পারছেন না বলে জানানো হয়েছে। ”
তবে প্রধানমন্ত্রী দ্রুত শিক্ষকদের সঙ্গে বসে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবেন বলে আশা পোষণ করেন আবুল কালাম আজাদ।
সংগঠনের সভাপতি মো: এশারত আলী বাংলানিউজকে বলেন, শিক্ষকরা প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে কর্মসূচি স্থগিত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে গেছেন। আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের অপেক্ষায় আছি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক দিক বিবেচনায় হলেও শিক্ষকদের প্রতি সদয় হবেন বলে প্রত্যাশা এ শিক্ষকনেতার।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১২
জেডএম/এনএস