ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৬ মাঘ ১৪৩১, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৯ রজব ১৪৪৬

শিক্ষা

সরকারের সিদ্ধান্ত মানছে না স্কুল কর্তৃপক্ষ

মো. জাহিদ হাসান জিহাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০২৫
সরকারের সিদ্ধান্ত মানছে না স্কুল কর্তৃপক্ষ

কুষ্টিয়া: কুষ্টিয়ায় সরকারি নীতিমালা বাস্তবায়নে জেলা শিক্ষা প্রশাসনের নেওয়া ভর্তি ও টিউশন ফি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত মানছে না জেলার কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।  

সরেজমিনে গৃহীত সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে মানা হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে কার্যকরী কোনো মনিটরিং না থাকায় শিক্ষার্থী ভর্তি ও মাসিক টিউশন ফি আদায়ে নীতিমালা ধার্যকৃত ফি’র তুলনায় ক্ষেত্র বিশেষে প্রতিষ্ঠানগুলি যাচ্ছেতাই আর্থিক বোঝা (২শ গুণেরও বেশি) অভিভাবকদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের রহস্যজনক নীরবতায় প্রতিষ্ঠানগুলির এমন বেপরোয়া আচরণে ভুক্তভোগী অভিভাবকদের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ তীব্র হয়ে উঠছে বলেও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো লিখিত অভিযোগ পাননি জানিয়ে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রশাসনের।

২০২৫ সালের নতুন শিক্ষা বর্ষে ভর্তি সংক্রান্ত পরিপত্র সূত্রে জানা যায়, ‘মহানগরী/সিটি করপোরেশন, পৌর-জেলা ও পৌর উপজেলা এবং মফস্বল ভেদে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি ক্ষেত্র বিশেষে নতুন ক্লাসে ভর্তির জন্য অনধিক ২১টি খাত উল্লেখ করত: পৌর জেলা ও পৌর উপজেলা এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলে অনধিক ১ হাজার ৮৫০ টাকা নিতে পারবে এবং মফস্বল এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলে অনধিক ১ হাজার ৬৪৫ টাকা আদায় করা যাবে। তবে শর্ত থাকে যে প্রতিষ্ঠানগুলিতে উল্লেখিত খাত সমূহের বাস্তব উপস্থিতি বা শিক্ষার্থীদের এসব খাতের ইউটিলিটি নিশ্চিত থাকতে হবে।

যদিও পরিপত্রে উল্লেখিত ২১টি খাতের মধ্যে অর্ধেক সংখ্যক খাতেরও কোনো উপস্থিতি প্রতিষ্ঠানগুলিতে নেই। পরিপত্রে পরীক্ষার ফি বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে- তিন ঘণ্টার পরীক্ষার জন্য প্রতিটা বিষয় বাবদ ৪০টাকা হারে আদায় করা যাবে। অতঃপর টিউশন ফি নির্ধারণ সংক্রান্ত জেলা কমিটির ধার্যকৃত প্রতি শ্রেণির মাসিক টিউশন ফি বাবদ নেওয়া যাবে যথাক্রমে পৌর জেলা ও পৌর উপজেলার মধ্যে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে (প্রতিষ্ঠানের ফ্যাসিলিটির উপর ভিত্তি করে) ন্যূনতম ৮০টাকা তবে অনধিক ১২০টাকা আদায় করা যাবে। একইভাবে ৭ম শ্রেণিতে ন্যূনতম ৯০ টাকা এবং অনধিক ১৩০ টাকা। ৮ম শ্রেণিতে ১শ ১৪০ টকা, ৯ম ও ১০ম শ্রেণিতে ১২০ টাকা থেকে ২শ টাকা পর্যন্ত, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ২শ থেকে ২৮০টাকা পর্যন্ত।

তবে এক্ষেত্রে মফস্বল এলাকার প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত মাসিক টিউশন ফি ধার্য করা হয়েছে যথাক্রমে- ৬ষ্ঠ শ্রেণির জন্য ৫০ থেকে ১শ টাকা, ৭ম শ্রেণিতে ৬০ থেকে ১১০টাকা, ৮ম শ্রেণিতে ৭০ থেকে ১৪০ টাকা, ৯ম ও ১০ম শ্রেণির জন্য ৮০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির জন্য ১৭০ থেকে ২২০ টাকা পর্যন্ত।

ইতোমধ্যে জেলার সব এমপিওভুক্ত ও নন এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি কোনোভাবেই মানছেন না নীতিমালা নির্ধারিত ভর্তি ও টিউশন ফি বাবদ ধার্যকৃত ফি আদায়ের সিদ্ধান্ত। এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়ে সরকার গত ২৭ অক্টোবর ২০২৪ একটি পরিপত্র জারি করেছে।

এই পরিপত্র অনুযায়ী দেশের সব মাধ্যমিক ও উচ্চ উচ্চশিক্ষা বিভাগের আওতাধীন এমপিওভুক্ত ও নন এমপিও প্রতিষ্ঠানের জন্য টিউশন ফি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসককে সভাপতি ও জেলা শিক্ষা অফিসার মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে সদস্য সচিব করে টিউশন ফি নির্ধারণ কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিতে এমপিওভুক্ত ও নন এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদেরও সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

গেল ২৯ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা শিক্ষা কমিটির সংশ্লিষ্ট সদস্যদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সভায় প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছে। অথচ কেউই মানছেন না নীতিমালা ও জেলা শিক্ষা কমিটি কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত।  

সরেজমিনে জেলা শীর্ষস্থানীয় দুটি এমপিওভুক্ত এবং দুটি নন এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে ২০২৫ সালে নতুন বর্ষে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি ও মাসিক টিউশন ফি বাবদ শিক্ষার্থী/অভিভাবকদের কাছ থেকে আদায়কৃত তুলনামূলক টাকার পরিমাণ চিত্রে দেখা যায় যথাক্রমে- স্বয়ং জেলা প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত এমপিওভুক্ত ‘কুষ্টিয়া কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজে’ ভর্তি ফি- ৩ হাজার ৩শ টাকা এবং মাসিক টিউশন ফি- ৭শ টাকা। জেলার পুলিশ প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত এমপিওভুক্ত ‘পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভর্তি ফি ৩ হাজার ৫২০টাকা এবং মাসিক টিউশন ফি- ৭শ টাকা।

একইভাবে জেলার শীর্ষস্থানীয় দুটি নন এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে- ‘এডুকেয়ার আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মোট ৪টি খাত উল্লেখ পূর্বক ভর্তি ফি আদায় করছেন- ১২ হাজার ৬শ টাকা এবং মাসিক টিউশন ফি- ২ হাজার ৮শ টাকা। অপর নন এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘হাসিব ড্রিম স্কুল অ্যান্ড কলেজের (বাংলা মাধ্যম) ৪টি খাত উল্লেখ পূর্বক ভর্তি ফি আদায় করছেন- ২০ হাজার টাকা এবং মাসিক টিউশন ফি- ২ হাজার ৭শ টাকা ছাড়াও মাসিক টিফিন ফি- ৪শ টাকা।  

এছাড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র থানামোড়স্থ ‘সান আপ স্কুল অ্যান্ড কলেজে (বাংলা মাধ্যম) ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি ফি নেওয়া হচ্ছে- ১০ হাজার ৩শ টাকা এবং প্রতি ১ মাসের বেতন ১ হাজার ৮শ টাকা।

কুষ্টিয়া জেলা শিক্ষা অফিসের গবেষণা কর্মকর্তা মো. সবুজ হোসেন বলেন, ২০২৫ সালে নতুন শিক্ষাবর্ষে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তিকৃত ৪৬ হাজার ৩৫০ জন শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যের বই সরবরাহ করা হয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে রয়েছে- সরকারি, এমপিওভুক্ত এবং নন এমপিওভুক্ত সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের এসব নতুন বই দেওয়া হয়েছে।  

এছাড়া অন্যান্য শ্রেণির বই পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে- ৭ম শ্রেণি- ৪২ হাজার ৬৫০ জন, ৮ম শ্রেণি- ৪১ হাজার ২শ, ৯ম শ্রেণি- ৩৮ হাজার ৫৫০ জন ও ১০ম শ্রেণিতে ৩৪ হাজার ৯৫০ জন নতুন বছরের বই পেয়েছে’।  

জেলা শিক্ষা অফিসের এই পরিসংখ্যান মতে জেলায় এ বছর নতুন শ্রেণিতে ভর্তিকৃত শুধুমাত্র ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি নীতিমালা বহির্ভূত অবৈধভাবে গড়ে (ভর্তি ও টিউশন ফি খাত) মাত্র এক হাজার টাকা অতিরিক্ত আদায় করে থাকলেও সেই টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ কোটি ৬৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এভাবে ৬ষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলি অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রতি শ্রেণিতে পৃথক ভাবে যে টাকা আদায় করেছে তার পরিমাণ যোগ, বিয়োগ, গুন ও ভাগ করলে যেকোনো প্রাথমিক শিক্ষার জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি বা নাগরিকই বুঝতে পারবেন কি পরিমাণ টাকা অবৈধভাবে শিক্ষা খাত থেকে আদায় করা হচ্ছে। এতো বড় পুকুর চুরির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রশাসনের উদ্যোগহীন নীরব ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগী অভিভাবকরা।

কুষ্টিয়া শহরের কোর্ট পাড়ার বাসিন্দা অভিভাবক শেহাব উদ্দিন তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘এসব জেগে থাকা ঘুমন্ত কর্তাবাবুদের ভেলকিবাজি তামাসা ছাড়া কিছুই না। নতুন ক্লাসে ভর্তি ও মাসিক টিউশন ফি বিষয়ক সরকারি পরিপত্র এবং মন্ত্রণালয়ের কঠোর নির্দেশনা থাকার পরও সেগুলি তুচ্ছ জ্ঞান করে চলেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি? তারা রাষ্ট্রের সব রকম সুবিধা নেবেন আর রাষ্ট্রের বিধি বিধান আইন কানুন মানবেন না; এবং আইন ভঙ্গকারী এসব বেপরোয়া প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন রহস্যজনক কারণে কোনো পদক্ষেপও নেবেন না; সেটা কি করে সম্ভব? বরং অদৃশ্য কারণে প্রশাসনের কোনো ভূমিকা না থাকায় লাগামহীন ভাবে শিক্ষা ব্যয় বেড়েই চলেছে’।

শহরের মজমপুর এলাকার অভিভাবক আছমা হক বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ বিষয়ক কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে মাসিক বেতন ন্যূনতম ৮০ টাকা তবে ক্রমাধিক সুবিধা প্রাপ্তির ভিত্তিতে সেটা কোনোভাবেই ১২০ টাকার অধিক হবে না। আপনারা যান দেখে আসুন স্বয়ং সভাপতির নিজের স্কুলেই মাসিক বেতন আদায় করছেন ৭শ টাকা। পুলিশ প্রশাসন পরিচালিত পুলিশ লাইন্স স্কুলেও একই অবস্থা। আদৌ কি কেউ আছেন এসব দেখে সমাধানের উদ্যোগ নেবেন’?

নীতিমালা বহির্ভূত ভর্তি ফি এবং অতিরিক্ত টিউশন ফি আদায় বিষয়ে ‘পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক মো. নাজমুল আরেফিন বলেন, প্রতি বছরই ভর্তি এবং টিউশন ফি কত টাকা নির্ধারণ করা হবে তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত থেকে নির্ধারিত হয়ে থাকে’। এখানে কারো ব্যক্তিগত বা মনগড়া কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই’।  

কুষ্টিয়া জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মুন্সী কামরুজ্জামান বলেন, ‘মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ বিষয়ক জেলা শিক্ষা কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত বেতন ফি’র অতিরিক্ত টাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি আদায় করছেন এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে অবশ্যই তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।

জেলা শিক্ষা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মো. তৌফিকুর রহমান জানান, ‘সরকারি নীতিমালা ও পরিপত্রে নির্ধারিত ভর্তি ফি’র তুলনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে, এমন অভিযোগ তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তার নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজেও নীতিমালা ও পরিপত্রের নির্দেশনা মানছেন না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বাংলাদেশ সময়: ১২২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০২৫
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।