ঢাকা: পরীক্ষা শেষের মাত্র ২০ মিনিট বাকি তখন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে কিছুটা জটলা।
খুলনার ছেলে আব্দুল কাদের শুক্রবার ভোরেই এসে নেমেছেন ঢাকায়। জীবনে এটিই তার প্রথম রাজধানীতে আসা। তবে ভোরে এলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি খুঁজে পেতে পেতে সময় গড়িয়ে ১০টা ৪০ মিনিট। পরীক্ষা শুরু হয় সকাল ১১টায়।
এভাবেই ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে এসে হয়রানির শিকার হচ্ছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা। শুক্রবার সকাল ১১টা থেকে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের (‘গ’ ইউনিট) পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতি বছরের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়। একই দিনে বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরীক্ষা দিতে এসে এ ধরনের বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন ভর্তি পরীক্ষার্থীরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে মারাত্মক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা।
এ ধরনের কষ্ট লাঘবের জন্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার জন্যে বারবার অনুরোধ করা হলেও আমলে নিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
শুক্রবার সকালে ভর্তি পরীক্ষার সময়টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মলচত্ত্বর এলাকা দেখে মনে হয়, যেন কোনো বাস টার্মিনাল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এর আগের রাতে অথবা মধ্যরাতে পরীক্ষার্থী নিয়ে রওনা দিয়েছে এসব বাস।
নাটোর থেকে বৃহস্পতিবার রাতে রওনা দিয়ে ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন রহিম মিয়া। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, পথে অনেক কষ্ট হয়েছে। কোচিং সেন্টার থেকেই এ বাস ঠিক করা হয়েছে। একসঙ্গে ৫২ জন শিক্ষার্থী ও অভিভাবক এই বাসে করে এসেছেন।
তিনি জানান, ঢাকায় তাদের নিকটাত্মীয় কেউ নেই, এ কারণেই কোচিংয়ের মাধ্যমেই ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেবেন ছেলে শাহজাহান। ওই পরীক্ষাগুলোর সময়ও একইভাবে কোচিংয়ের ঠিক করা ট্রান্সপোর্টের মাধ্যমে পরীক্ষায় অংশ নেবেন তিনি।
তাই পরীক্ষা শেষে শুক্রবার বিকেলেই আবার নাটোরের উদ্দেশ্যে রওনা করেন তারা।
ফেনী থেকে মেয়ে রিক্তাকে নিয়ে এসেছেন মোহাম্মদ আমিন। তিনি বলেন, এখানে এসে পরীক্ষার হল খুঁজে পেতেই অনেক সময় লেগেছে। সামনে আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা রয়েছে। তখন আবার এই ধরনের কষ্ট করতে হবে।
গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের উদ্যোগ নিলে সবচেয়ে ভালো। একবারেই ভর্তি পরীক্ষা হলে বারবার এতো ধকল আর খরচ হতো না।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রী) অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা একজন শিক্ষার্থীর জন্য অনেক কঠিন। বিদ্যমান প্রক্রিয়ায় তিনি তার মেধার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন না। গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি ব্যবস্থা চালু হলে শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ বাড়বে। কিন্তু কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতি অনুসরণ করতে এখন পর্যন্ত রাজি হচ্ছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্ত্বশাসন খর্ব করে আমরা এ পদ্ধতি প্রবর্তন করতে চাই না- জানান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে উচ্চশিক্ষায় প্রতি বছরই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী যুক্ত হচ্ছেন। আগে শিক্ষার্থী সংখ্যা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম ছিল। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পৃথকভাবে ভর্তি পরীক্ষার নিয়ম প্রচলন করা হয়। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক বেড়েছে। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে ও হচ্ছে। অনেকগুলো পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করায় অর্থ এবং সময়েরও অপচয় হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এ সমস্যার নিরসনে গুচ্ছ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা প্রবর্তনের বিকল্প নেই।
২০০৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়ার সংস্কার নিয়ে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে বৈঠক করেন। তাতে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়। তখন এ পদ্ধতির সুফল শিক্ষার্থীরা পাবে বলে অধিকাংশ উপাচার্যই একমত পোষণ করেন। তবে বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ত্বশাসন খর্ব হওয়ার আশঙ্কা করেন।
২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ভিসিদের নিয়ে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বুয়েট) কয়েকটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণে অসম্মতি জানায়।
২০১০, ২০১১ এবং ২০১২ সালেও এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় উপাচার্যদের সঙ্গে বৈঠক করে। প্রতিবারই বিষয়টি যাচাই-বাছাই করতে সময় নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত বছরের জুলাই মাসেও এ পদ্ধতি প্রণয়নের বিষয়ে ভিসিদের নিয়ে বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী। তখনও অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এ পদ্ধতির পক্ষে সম্মতি দিলেও বড় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবের বিপক্ষে মত প্রকাশ করে।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, বেশ কয়েকবার অনুরোধ করার পরেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের মতো চলছে। আমরা তাদের স্বায়ত্ত্বশাসনের ওপর প্রভাব খাটাতে পারি না।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্যে কোচিং সেন্টারে ৩২ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। শিক্ষার্থীরা জানেন, কোনো কোচিংয়ে ভর্তি হলে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যাবে। একজন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করতে এক ঘণ্টার পরীক্ষাকে আপনারা মূল্য দেন। তিনি যে এর আগে ৪০-৫০ ঘণ্টার পরীক্ষা দিয়ে আসছেন, তার মূল্য দেন না।
মন্ত্রী বলেন, ভর্তি প্রক্রিয়ায় কতো টাকা আয় হয়, আমরা জানি না! কে কতো টাকা ভাগ পান, আমরা সবই জানি।
মন্ত্রী বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৯৫ শতাংশ অর্থায়ন করে সরকার। তবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না এক শতাংশও।
বাংলাদেশ সময়: ২০১০ ঘন্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৪