ঢাকা, শনিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

মুখ থুবড়ে পড়েছে স্বাক্ষর শেখানো কর্মসূচি!

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৮, ২০১৪
মুখ থুবড়ে পড়েছে স্বাক্ষর শেখানো কর্মসূচি! ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: খড়ি দিয়ে মাটিতে দাগ কেটে পাশের বাড়ির নিরক্ষর রেণুকে নিজের নাম লেখাতে শেখান মাহমুদ। সেটা আরো দু’যুগ আগেকার কথা, যখন মাহমুদ স্কুল পড়ুয়া।

এভাবেই সরকারের সাক্ষরতা অভিযানে অংশ নেওয়ার কথা বাংলানিউজকে জানান তিনি।

তবে নিজের নাম লিখতে পারলেও রেণু সত্যিই কি অক্ষর জ্ঞান অর্জন করেছেন? সময়ের সঙ্গে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে স্বাক্ষর করতে পারা মানুষই শিক্ষিত নয়। অক্ষর জ্ঞান না দিয়ে শুধু স্বাক্ষর শেখানোর এ কর্মসূচি  তাই মুখ থুবড়ে পড়ে।

গত বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাক্ষরতা মূল্যায়ন জরিপ (২০১১) অনুযায়ী দেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৫৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে নারী সাক্ষরতার হার ৫০ দশমিক ২ শতাংশ ও পুরুষ ৫৬ দশমিক ৯ শতাংশ।

ইউনেসকোর মাপকাঠি অনুযায়ী এ সাক্ষরতার হার নির্ণয় করা হয়। জরিপে ১১ থেকে ৪৫ বছর বয়সের জনসংখ্যার সাক্ষরতা পরিমাপ করা হয়।

সাক্ষরতা বলতে, পড়তে, লিখতে এবং বলতে পারাকে বোঝায় ইউনেসকো। ইউনেসকো শুধু শিক্ষিতকেই সাক্ষরতা জ্ঞান সম্পন্ন বোঝায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের (আইইআর) তথ্যমতে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সাক্ষরতার আনুমানিক গড় হার ৭০.৩০ শতাংশ। সেদিক থেকে বেশ পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।

আইইআর’র গবেষক মাহফুজুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, দেশে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি করতে বাংলাদেশে দরিদ্র ও অনগ্রসর পরিবারের শিশু-কিশোর ও বয়স্ক নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি চালু করে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা।

তিনি বলেন, তবে ওই কর্মসূচির আওতায় নিরক্ষরকে শুধু নাম লেখানোই শেখানো হয়। যেটা বাস্তবে টিপসইয়ের চেয়ে আলাদা কিছু ছিল না। এটা এক সময়ে ব্যর্থ হয়।

এদিকে দেশের সাক্ষরতার হার নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তথ্যে রয়েছে বড় ধরনের ফারাক।

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর দেওয়া তথ্যমতে, দেশে সাক্ষরতার হার ৫৯ দশমিক ৮২। আবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সাক্ষরতার হার ৭১ ভাগ।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, আগে শুধু নাম লিখতে পারলেই তাকে ‘সাক্ষর’ বলা হতো। তবে এখন সেটি পরিবর্তন হয়েছে। এখন পড়তে এবং লিখতে পারতেও হবে। ৪ ধরনের নির্ণয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সাক্ষর হিসেবে সার্টিফাইড করা যাবে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি একনেকে মৌলিক সাক্ষরতা নামে একটা প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ৪৫ লাখ নিরক্ষর মানুষ সাক্ষরতা পাবে। ২০১৮ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হবে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর অধীনে ৬৪ জেলায় প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। ৪৫২ কোটি ৬২ হাজার টাকা ব্যয় মৌলিক সাক্ষরতা দেওয়া হবে।

ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের সাবেক সভাপতি এম আর খায়রুল উমাম জানান, এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্যে সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে। এর আগে ১৯৯৬-২০০১ সময়ে সরকার টোটাল লিটারেসি মুভমেন্ট নামে প্রকল্প করে দেশে নিরক্ষরতা দূরীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যয় করা সমুদয় অর্থই গচ্চায় যায়। তবে এ সাক্ষরতা অভিযানের সফলতা দাবি করে অনেক জেলা নিরক্ষরতামুক্ত বলে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছিল!

তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী সাক্ষরতার সংজ্ঞা পরিবর্তন করে আমাদের দেশে কোনোরকমে নিজের নামটা লেখা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রেখে সাক্ষর করে তোলার উদ্যোগ ছিল। তবে সেটিও সফল হলে হতো, নিরক্ষররা অক্ষর জ্ঞান না হোক অন্তত একটা টিপসইবিহীন দেশ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া যেত।

খায়রুল উমাম বলেন, দেশের ১ থেকে ৪৫ বছর বয়সী সব মানুষকে সাক্ষরতার আওতায় আনা সম্ভব হলে সামাজিকভাবে সবাই লাভবান হবে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক শ্যামল কান্তি ঘোষ বাংলানিউজকে বলেন, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদফতর এখন সাক্ষরতার পাশাপাশি অর্জিত সাক্ষরতার স্থায়ীত্ব নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে অব্যাহত শিক্ষার ক্ষেত্রে। মৌলিক সাক্ষরতা কর্মসূচির শেষে বিভিন্ন মেয়াদের কর্মসূচির মাধ্যমে যাতে নব্য সাক্ষরগণ অর্জিত সাক্ষরতার চর্চা ধরে রাখতে পারে এবং সাক্ষরতাকে তার স্বীয় প্রয়োজনে দৈনন্দিন জীবন-জীবিকা নির্বাহে কার্যকর ভাবে ব্যবহার করতে পারে এজন্য রয়েছে উপানুষ্ঠানিক অধিদফতরের বিভিন্ন কর্যক্রম।

তিনি জানান, দেশের ৬৪টি জেলায় গ্রাম শিক্ষা মিলন কেন্দ্র নামে ৯৩৫টি গ্রামীণ পাঠাগার রয়েছে। এসব পাঠাগারে অব্যাহত শিক্ষা কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। এসব কেন্দ্রে সাক্ষরতা চর্চার পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা।

১৯৬৫ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো নিরক্ষর মানুষের মধ্যে অক্ষরজ্ঞান ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে জাতিসংঘ এবং ইউনেস্কোর সদস্য হিসেবে সকল উন্নত এবং উন্নয়শীল দেশ প্রতিবছর বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উদ্যাপন করে আসছে।

বাংলাদেশ সময়: ১০০৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।