ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

শিক্ষা

রাবি শিক্ষক হত্যা

সন্দেহের তীর ‘আটক’ এক ছাত্রী ও তার বয়ফ্রেন্ডের দিকে!

শরীফ সুমন ও রফিকুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১৪
সন্দেহের তীর ‘আটক’ এক ছাত্রী ও তার বয়ফ্রেন্ডের দিকে!

রাজশাহী: রাজশাহীতে দিনে দুপরে শিক্ষককে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হলেও চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের মোটিভ দুই দিনেও বের করতে পারেনি পুলিশ। সময় যত যাচ্ছে রহস্য ততই ঘনীভূত হচ্ছে।

ব্যক্তিজীবনসহ চারটি ‘ক্লু’ নিয়ে এগোলেও এখন পর্যন্ত কোনো হত্যারহস্য উন্মোচনের ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারেনি পুলিশ।

তবে শেষ পর্যন্ত তদন্ত গড়াতে যাচ্ছে একই বিভাগের ছাত্রী ও তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে। ওই ছাত্রী এখন পুলিশের হাতে আটক। যতদূর জানা যায়, পুলিশের সন্দেহের তীর এখন তাদের দিকেও। মতিহার থানাপুলিশ  আটকের কথা স্বীকার করলেও মহানগর ডিবি পুলিশ তা স্বীকার করছে না। তাই এ-নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াশা।

এদিকে এরই মধ্যে মহানগর পুলিশ কমিশনারকে রাজশাহী থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। মামলার স্বার্থে সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে স্বাভাবিক নিয়মেই পুলিশি তদন্ত একেকবার একেক দিকে ধাবিত হচ্ছে।

স্থানীয় লোকজন জানান, রাবি শিক্ষক খুনের পর ওই দিন রাতেই তার বাসা থেকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্রীকে আটক করে পুলিশ। কিন্তু প্রথম দিকে এ ব্যাপারে কোনো তথ্যই প্রকাশ করেনি তারা। আটক করার সময় ওই ফ্লাট বাইরে থেকে তালাবদ্ধ ছিল। আটক ছাত্রী এবার মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছেন। প্রথম দিনের আটক ২০ জনের মধ্যে তিনিও ছিলেন। তার মা’কে এরই মধ্যে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের বাড়ি উত্তরবঙ্গেরই একটি জেলায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিহত শিক্ষকের কয়েকজন প্রতিবেশী বাংলানিউজকে জানান, হত্যাকাণ্ডের আগের দিন দুপুরে একটি মেয়ে ওই বাসায় প্রবেশ করে। পরে তাকে আর কেউ বের হতে দেখেনি। হত্যাকাণ্ডের পরপরই মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সদস্যরা বাড়িটি ঘিরে ফেলেন। তারা ওই ফ্লাটের তালা ভেঙে তল্লাশি চালান। এ সময় বাড়ির একটি কক্ষ থেকে ওই ছাত্রীকে আটক করে পুলিশ।

ধারণা করা হচ্ছে, অধ্যাপক শফিউল ইসলাম লিলন হত্যার মূল মোটিভ উদ্ধারে ওই ছাত্রী এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে পুলিশের কাছে। ‘চাঞ্চল্যকর তথ্য’ পাওয়া গেছে বলেই হয়তো তার ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো তথ্য দিচ্ছে না পুলিশ। ‘ক্লু’ উদঘাটনে গোয়েন্দারা ওই ছাত্রীকে নিয়ে কাজ করছেন।
 
জানা গেছে, পুলিশের তদন্তের আওতায় এসেছে ওই ছাত্রীর বয়ফ্রেন্ডও। আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।

ওই বয়ফ্রেন্ডের খোঁজে ইতোমধ্যে মহানগরের শ্যামপুরসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে বলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছেন।

তবে ওই ছাত্রীকে আটক করা নিয়েও মিলেছে দুই ধরনের তথ্য। তাই এ নিয়েও তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন বাংলানিউজের কাছে ওই ছাত্রীকে আটক করার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘তাকে আটকের পর গোয়েন্দা কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে এ ব্যাপারে এখনই বিস্তারিত কিছু বলা যাবে না। ’

অপরদিকে রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মজিদ দাবি করেন, কোনো ছাত্রী আটকের ব্যাপারে তার কাছে কোনো তথ্য নেই। ডিবি কার্যালয়ে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের কথাও অস্বীকার করেন তিনি। এছাড়া আটক ৩৪ জনের মধ্যে আজ সোমবার ১১ জনকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হলেও এদের তালিকায় ওই ছাত্রী নেই।  

বর্তমানে হত্যারহস্য বের করতে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া সিরিঞ্জ-তুলা, সাধন লেখা চাপাতি (ধারালো অস্ত্র) ও রাবি শিক্ষকের মোবাইল ফোনের যোগসূত্র খুঁজছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। তাই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে কোনো নিশ্চিত ফলাফলে না পৌঁছানো পর্যন্ত মোটিভ থাকছে রহস্যাবৃতই।   

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভাগীয় কয়েকজন শিক্ষকের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাউলমনা রাবি শিক্ষক লিলন কখনও সংসার জীবনে স্থিতিশীল হতে পারেননি। ২০০৩ সালে তার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি আরও দু’টি বিয়ে করেন। কিন্তু তার বাউলজীবন তাকে সংসারের মায়ায় বেঁধে রাখতে পারেনি। এদের প্রত্যেকের সঙ্গে তালাকের মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটেছে।

এর মধ্যে তার দ্বিতীয় স্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকার নজরুল ইসলামের মেয়ের সঙ্গে সংসারজীবনে বিবাদ শুরু হলে তার স্ত্রী ওই শিক্ষকের নামে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করেন। পরে ২০০৮ সালে তা পারিবারিকভাবেই মীমাংসা হয়ে গেলে মামলাটি তুলে নেওয়া হয়। এজন্য ড. শফিকুল ইসলাম তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে দেনমোহর বাবদ ৬ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তার একমাত্র ছেলে জেবিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।

র‌্যাব-৫ সদর দপ্তরের অদূরে বিহাস পল্লীর পার্শ্ববর্তী এলাকার একটি ফ্লাটে নিভৃতে থাকতেন। বগুড়ার সোনাতলায় ছোট থেকে বড় হয়েছেন তিনি। ১৯৮১ সালে সোনাতলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং স্থানীয় কলেজ থেকে ১৯৮৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। পরে ১৯৮৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৮৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করার পর সমাজবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৯১ সালে। এরপর থেকে তার শিক্ষকতা জীবন শুরু। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা জীবনে তার একাধিক গবেষণা রয়েছে। বের করেছেন সমৃদ্ধ প্রবন্ধও।

শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে রাবি সংলগ্ন চৌদ্দপাই এলাকায় নিজ বাসার সামনে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম শফিউল ইসলাম। পরে ৪টার দিকে রামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

বাংলাদেশ সময়: ০০০৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।