ঢাকা: সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য শাজাহান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আমিনুদ্দিনের নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, জালিয়াতিসহ বিভিন্ন সিরিজ অপকর্মের কারণে ডুবতে বসেছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এক সময়ের সেরা এ বিশ্ববিদ্যালয়টি কোনো নীতি-নিয়মের তোয়াক্কা করছে না! অনিয়মই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে ভিসি আমিনুদ্দিন আর শাজাহানের কাছে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পুরো একনায়কতান্ত্রিক কায়দায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত করে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত তারা। একসময় শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দে থাকা এ বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে ভর্তির জন্য ছাত্রও খুঁজে পাচ্ছে না। আগামী সেশন থেকে ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই শিক্ষার্থী ভর্তির কথা ভাবছে প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকই জানিয়েছেন এসব তথ্য। বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি, লুটপাটের পরেও ইউজিসির কালো তালিকাভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নর্থ সাউথের তাহলে পার্থক্য কোথায়?- এ প্রশ্ন এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষক-কর্মকর্তা, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। দীর্ঘ ২২ বছর পরিচালিত হয়ে আকাশচুম্বী সুনাম অর্জনের পর বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্রুত অবনতিশীল অবস্থার জন্য দায়ী কে? ছাত্রছাত্রী,
শিক্ষক-অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এর পেছনে হাত রয়েছে ভিসি আমিনুদ্দিন সরকার আর শাজাহানের। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কিছুতেই শিক্ষকদের কথা বলার সুযোগ দিতে নারাজ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটিগুলোও কোনো কাজে আসে না। ভিসি এসব কমিটির সিদ্ধান্তকে তোয়াক্কা করেন না। তার যে কোনো সিদ্ধান্ত তিনি বোর্ডকে বুঝিয়ে পাস করে নেন। পরে তা শিক্ষক-কর্মচারীদের বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, তাদের বেতন নির্ধারণ, বৃদ্ধি ইত্যাদিও করে থাকেন তিনি নিজেই। কিন্তু চাকরি হারানোর ভয়ে ভিসির বিরুদ্ধে কেউই মুখ খুলতে সাহস পান না। ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের শাসিয়ে দিয়েছেন, তার কোনো সিদ্ধান্তে কেউ দ্বিমত পোষণ করলেই তাকে তাৎক্ষণিক অব্যাহতি দেওয়া হবে।
সম্প্রতি ডিন ও চেয়ারম্যানদের সঙ্গে একটি সভা করে তিনি ঘোষণা দেন, ‘আমি অতীতে অনেক ব্যক্তিকে চাকরিচ্যুত করেছি। নর্থ সাউথের ভিসি থাকাকালেও এর ব্যতিক্রম হবে না’। এ বক্তব্যে ভয় পেয়ে কিছু কিছু শিক্ষক ট্রাস্টি বোর্ডকে এ ব্যাপারে জানান।
পরে ভিসির কাছে এ ব্যাপারে ব্যাখা চাওয়া হলে ‘এটি একটি গুজব মাত্র’ বলে পার পেয়ে যান। জানা যায়, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের কমিটিতে তিনি পূর্ব নির্ধারিত তালিকা নিয়ে হাজির হন। তালিকার প্রার্থীদের যোগ্যতা যাই হোক তিনি তার পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দেন। বরখাস্তও করা হয় তার ইচ্ছমতোই। কেউ তাদের দুর্নীতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেই নেমে আসে খড়গ। এক্ষেত্রে যেন আইনের বালাই নেই এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।
সম্প্রতি শাজাহানের বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন লঙ্ঘন করে প্রো-ভিসি ড. এ এন এম মেশকাত উদদীনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত করা হয়। নিয়মবহির্ভূতভাবে তাকে চাকরিচ্যুত করায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আইনি জটিলতায় ফেঁসে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাবেক চেয়ারম্যান বর্তমানে ট্রাস্টি বোর্ড সদস্য শাজাহানের রোষানলে যিনি পড়েছেন, তাকেই এই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জানান, ভিসি অধ্যাপক আমিনুদ্দিন সরকার শিক্ষাজীবনে দ্বিতীয় শ্রেণির ফলাফলপ্রাপ্ত। তিনি ঢাবি মৃত্তিকাবিজ্ঞান থেকে পাস করেন। পেশাজীবন শুরু করেন বন কর্মকর্তা হিসেবে। পরে আমেরিকা গিয়ে অর্থনীতিতে পিএইচডি করেন। বন বিভাগের সাবেক এ কর্মকর্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পদে থাকেন কীভাবে এটিও এখন ‘টক অব দ্য ক্যাম্পাস’-এ পরিণত হয়েছে। আর কেনইবা তাকে প্রতি মাসে ১৬ লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে এর উত্তরও কেউ মেলাতে পারছেন না।
জানা গেছে, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী। মোটা অংকের টাকা এসব শিক্ষার্থীর কাছ থেকে আদায় করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টে অর্থের কোনো জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের অনেকেই বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য শাজাহান এটিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বানিয়েছেন। তার স্বেচ্ছাচারিতায় পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জিম্মি হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের কয়েকশ কোটি টাকা নিজের ইচ্ছামতো তুলছেন, খরচ করছেন। আইনের তোয়াক্কা না করেই চলছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, বৃহৎ স্বার্থে ট্রাস্টে টাকা জমা হওয়ার কথা থাকলেও এর কোনো স্বচ্ছতা নেই। শিক্ষকদের কাউকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বাইরে পিএইচডি করার সুযোগও দেওয়া হয় না। গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্বার্থেও ব্যয় হয় না এসব অর্থ। তাহলে এসব অর্থ ব্যয় হয় কোন খাতে?শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও রয়েছে অনিয়ম। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষকদের কোনো নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো নেই। চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। মাত্র এক বছরের চুক্তিতে শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়! প্রতিবছর শিক্ষকদের চাকরি নবায়ন করতে হয়। কেউ ভিসির বিরুদ্ধে কথা বললেই তার চাকরি নবায়ন নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় নিতে হয়! এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে চাপা ক্ষোভ। নর্থ সাউথ সম্পর্কে দেশজুড়ে মানুষের মধ্যে ভালো ধারণা থাকলেও কিছু ভয়ঙ্কর তথ্য পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তির দায়িত্বে থাকা সাবেক এক শিক্ষক জানান, সম্প্রতি সামার-২০১৪ সেমিস্টারে দুই হাজার তিনশত শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দেয়। ভর্তিতে পাস মার্ক ৬০ নির্ধারিত থাকলেও তা কমিয়ে ২৫-এ আনা হয়! এর মাধ্যমে ১৪০০ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। যেসব শিক্ষার্থী ২৫ মার্ক অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে তাদের মধ্য থেকে আরও ৪৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। তিনি জানান, আগে নর্থ সাউথের শিক্ষার মান ছিল উন্নত। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষা নিয়ে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পেত। কিন্তু বর্তমানে এর অবস্থা এতই খারাপ যে, শিক্ষার্থীরাও ভর্তির আগ্রহ দেখায় না। তাই প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস না করেও ভর্তি হয়ে যায়। নর্থ সাউথের শিক্ষার ক্রমাবনতিতে শিক্ষার্থীরা ভর্তির আগ্রহ না দেখানোয় টনকও নড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।
জানা যায়, সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কমিটির সভায় কোনো ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য প্রস্তাব দেন ভিসি আমিনুদ্দিন আহমেদ। কয়েকজন শিক্ষক ভিসির এ প্রস্তাবে দ্বিমত পোষণ করেন। কিন্তু ভিসি জোর দিয়ে বলেন, আগামী সেমিস্টার থেকে ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়া চালু করা হবে। সভায় থাকা এক শিক্ষক আক্ষেপ করে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সম্প্রতি কালো তালিকাভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করেছে। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম, শিক্ষার্থী ভর্তিতে অনিয়ম করাসহ বিশ্ববিদ্যালয় আইনকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। তাহলে কালো তালিকাভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নর্থ সাউথের পার্থক্য থাকল কোথায়?
বাংলাদেশ সময়: ০৭২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৪