জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির ও বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের আন্দোলনের ফসল বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের প্রশাসন। এবার এই প্রশাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে।
এসব নিয়ে প্রশাসনের উপর এখন বিএনপিপন্থি শিক্ষকরা যেমন ক্ষুব্ধ, তেমনই আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের একাংশ এবং বামপন্থি শিক্ষকরাও ক্ষুব্ধ। শিগগির এসব বৈষম্য অনিয়ম-পক্ষপাত ও প্রতিহিংসার অবসান ঘটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুস্থতা ও একাডেমিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনের প্রতি আহবান জানিয়েছেন প্রায় সব মত-পথের শিক্ষকরা।
সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেনবিরোধী আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দেননি এমন শিক্ষকরাই বর্তমান প্রশাসনের বিভিন্ন হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের একাংশ ও বামপন্থি শিক্ষকরা।
তাদের অভিযোগ, পিএইচডি ডিগ্রিধারী দর্শন বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়াকে তাঁর প্রাপ্ত ডিগ্রির স্বীকৃতি না দিয়ে একের পর এক হয়রানি করা হচ্ছে। পদোন্নতির সময় থেকে এই হয়রানি শুরু হলেও বর্তমানে তা প্রশাসনিক সেচ্ছাচারের উৎকট নজির হয়ে উঠেছে বলেই মনে করছেন তারা।
ঐ শিক্ষককের পিএইচডি ডিগ্রির মান যাচাইয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি কমিটি গঠন করলেও গত সিন্ডিকেট সভায় সেই কমিটির সুপারিশ আমলে না নিয়ে তা ইউজিসিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন।
অপরদিকে একই ধরনের পিএইচডি ডিগ্রি হলেও শুধুমাত্র বর্তমান প্রক্টর অধ্যাপক তপন কুমার সাহার স্ত্রী হওয়ায় রসায়ন বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপকের ক্ষেত্রে এই ডিগ্রিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন ঐ শিক্ষকরা। এভাবেই পক্ষপাতের উৎকট নজির স্থাপন করে চলেছে প্রশাসন।
অধ্যাপক এ এস এম আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি করেছি সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিঠি দিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে জানানো হয়েছে। তারপরও হয়রানি করা হচ্ছে।
প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সোহেল আহমেদকে অধ্যাপক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ও রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আতাউর রহমানকে পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে এবং জাহানারা ইমাম হলের আবাসিক শিক্ষক সৈয়দ মঈনুল আলম নিজারের পদ নবায়নের ক্ষেত্রে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তারা।
অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনিক আধিপত্য দিয়ে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের একজন শিক্ষককে চাকুরিচ্যুত করেছে বর্তমান প্রশাসন। নৃবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষককের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মচারীকে মারধরের অভিযোগ উঠলেও প্রশাসন অভিযুক্ত শিক্ষককে বেকসুর খালাস দিয়েছে। অথচ শিক্ষকরা এই ঘটনার নিরপক্ষে বিচার দাবি করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ বিবেচনায় বাসা বরাদ্দের ক্ষেত্রে বর্তমান প্রশাসন কেবল দলীয় শিক্ষকদেরকেই সুযোগ দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তারা। বামপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন ‘শিক্ষকমঞ্চ’র মুখপাত্র দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রায়হান রাইন দীর্ঘদিন ‘ডি’ টাইপের বাসায় রয়েছেন। এ পর্যন্ত তিনি ৫ বার আবেদন করেও উন্নত বাসা পাননি। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন উপাচার্য থাকাকালীন বিশেষ ব্যবস্থায় বাসা বরাদ্ধের প্রতিবাদ জানিয়ে আন্দোলন করেছিলেন বর্তমান প্রশাসনের পদধারীরা। কিন্তু ক্ষমতার পট বদলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তারাই আবার বিশেষ ব্যবস্থায় অপেক্ষাকৃত জুনিয়র শিক্ষক মার্কেটিং বিভাগের সভাপতি ও শেখ হাসিনা হলের এক আবাসিক নারী শিক্ষককে ‘বি’ টাইপ বাসা বরাদ্ধ দিয়েছেন। এমনই অভিযোগ করেছেন শিক্ষকরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরপন্থি ও বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের আন্দোলনের ফলে উপাচার্য পদ থেকে অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন পদত্যাগে বাধ্য হন। এরপর ২ মার্চ নির্বাচিত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। উপাচার্য নির্বাচনে বিএনপিসমর্থিত ১৫টি ভোট বর্তমান উপাচার্যর ঘরে যায় বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপিপন্থি একজন শিক্ষক নিশ্চিত করে জানান। তখন থেকে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরপন্থি ও বিএনপিপন্থি শিক্ষকরা জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন। আন্দোলন চলাকালে তারা এক প্যানেলে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনও করেন।
জোটবদ্ধ থাকায় উপাচার্য দায়িত্ব নেওয়ার ক’দিন পরই লাইব্রেরির ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক হিসেবে বিএনপিপন্থি একজন শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়ার কথা। কিন্তু প্রশাসন সেখানে আওয়ামীপন্থি একজন প্রভাবশালী শিক্ষককে দায়িত্ব দিয়ে সিন্ডিকেট কর্তৃক নতুন একটি পদ সৃষ্টি সাপেক্ষে অতিরিক্ত ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক হিসেবে বিএনপিপন্থি ঐ শিক্ষককে দায়িত্ব দেন। বিএনপিপন্থি শিক্ষকরা বিষয়টি ভালোভাবে নেন নি। তারা পদ গ্রহণ না করে প্রতিবাদ জানান। এই থেকে বর্তমান প্রশাসনের সঙ্গে বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সম্পর্কে চির ধরে।
এছাড়া গত ২ মাসে ২টি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের সাথে তাদের সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটে। ঈদুল আযহার আগে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামকে প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করার অনুরোধ জানান বিএনপিপন্থি শিক্ষকরা। উপাচার্য নিয়োগের বিষয়টি আপাতত সিন্ডিকেট সভায় না তোলার আশ্বাস দেন। অথচ ঈদের পর প্রথম সিন্ডিকেটেই শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি অর্ন্তভূক্ত করে ৪ জনের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঐ বিভাগে ৬ জন শিক্ষক নিয়োগ দেন।
নিয়োগের পরদিন বিএনপিপন্থি শিক্ষকরা প্রশাসনিক ভবনে গিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে অযোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দাবি করে তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং প্রতিবাদ জানান।
সে সময় বিএনপিপস্থি শিক্ষকদের সংগঠন ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম’ সদস্যসচিব ও গণিত বিভাগের অধ্যাপক মো. শরিফ উদ্দিন বলেন, উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে আমরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছি।
এছাড়া সরকার ও রাজনীতি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের অনুরোধ রাখেনি প্রশাসন। এ বিষয়টি নিয়েও ক্ষুব্ধ তারা।
শুধু প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগ ও পাবলিক হেলথ্ বিভাগে বিতর্কিত নিয়োগ দেওয়া হয়েছে উল্লেখ্য করে এই নিয়োগ পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানিয়েছেন আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের একাংশ ও বামপন্থি শিক্ষকরা।
প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে ক্ষেত্রে তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে নিয়োগ প্রার্থীদের যে মেধাতালিকা করা হয়, নিয়োগ দেয়া হয় সেই তালিকা নিচের দিক থেকে। যেমন, ১৫তম, ১৪তম, ১৩তম, ১০তম এইভাবে। চিত্রটি এমন যেন কম মেধাবী হওয়াই শিক্ষকতার বড় যোগ্যতা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. শামছুল আলম বলেন, প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর আমরা উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে কয়েক দফায় যোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য বলেছি। কিন্তু পরে যখন আমাদের মধ্যে আশংকা তৈরি হয় যে তিনি আসলে অযোগ্যদেরই নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন তখন আমরা নিয়োগ স্থগিত করতে বলেছি। কিন্তু তিনি আমাদের কথা শোনেননি।
তিনি বলেন, উপাচার্য নির্দিষ্ট গোষ্ঠি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে সঠিক পথে এগিয়ে যাবেন এটা আমরা আশা করি। তিনি যদি সঠিক পথে এগিয়ে যান তাহলে আমরা তাকে সহযোগিতা করব। তবেই বিশ্ববিদ্যালয় সুন্দরভাবে এগিয়ে যাবে।
আওয়ামীপন্থি শিক্ষক ও পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মোহা. মুজিবুর রহমান বলেন, ১৫ জনের মেধা তালিকার ১৫তম, ১৪তম, ১৩তম, ১০তমকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যা কাম্য নয়। নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হওয়া উচিত। কর্মচারী নিয়োগের জন্য অর্থ লেনদেনের কথাও শোনা যাচ্ছে। আগে যাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ছিল বর্তমান প্রশাসন তাদেরকেই আবার বিভিন্ন পদে বসিয়েছে। বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে তারা ক্যাম্পাসে যা ইচ্ছে তাই করছেন।
অপর এক আওয়ামীপন্থি শিক্ষক ও নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা অন্যায়কে অন্যায়ভাকে এবং ন্যায়কে ন্যায় হিসেবেই দেখি। নিয়োগের ক্ষেত্রে যে ডিসক্রিমিনেশন হয়েছে সেগুলো সমালোচনা করার অবকাশ অবশ্যই থাকে। ’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন বলেন, রায়হান রাইনের কোনো আবেদনপত্র পাইনি। যে-সকল শিক্ষক হলের সঙ্গে যুক্ত আছেন বাসা বরাদ্ধের ক্ষেত্রে তারা গুরুত্ব পাবেন এটাই নিয়ম। বিশেষ ব্যবস্থায় কোনো বাসা বরাদ্ধ দেওয়া হয়নি বলে দাবি করে তিনি বলেন, পয়েন্ট বেশি থাকায় তিনি(নারী শিক্ষক) বাসা পেয়েছেন।
অধ্যাপক পদে সোহেল আহমেদের নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণায় থেকে চিঠির মাধ্যমে আমাদের কাছে নির্দেশনা এসেছে। আমরা আবার চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছি এই নির্দেশনা রাষ্ট্রপতির কিনা। যদি হয় তবে সে অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে হয়রানির অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি দিয়ে যাচাই করা হচ্ছে। কিন্তু ইউজিসিতে পাঠানোর খবর সত্য নয়।
শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সিলেকশন বোর্ডের সুপারিশ সিন্ডিকেট সভায় গুরুত্ব পায়। সিলেকশন বোর্ড যা যোগ্য মনে করেছে সিন্ডিকেট সেটার অনুমোদন দিয়েছে। ’
সৈয়দ মঈনুল আলম নিজার হলের সভায় নিয়মিত উপস্থিত থাকেন না বলে তার পদ নবায়ন হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ২০১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৯, ২০১৪