জানা যায়, চাকুরিবিধি ভেঙে ও প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ‘কাউন্সেলিং অফিসার’ পদে উপ-উপাচার্যের আপন ভাগ্নি রিফাত জেরিনকে [(সমাজকর্ম থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সর্বনিম্ন ফলাফলধারী (২.৫০)] অস্থায়ী (অ্যাডহক) ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়।
রিফাত জেরিনকে ছাত্রকল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রে ‘কাউন্সেলিং অফিসার’ পদে স্থায়ীকরণ করার জন্য ১৪ নভেম্বর (মঙ্গলবার) সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে।
এই পদে একাধিক প্রার্থী আবেদন করেছেন, যারা ১৪ নভেম্বর ভাইবা দেবেন। কিন্তু তাদেরকে বাদ দিয়ে উপাচার্যের আত্মীয়াকেই এই পদে স্থায়ী করা হবে। এমনটাই অভিযোগ করেছেন খোদ উপাচার্য অফিসের নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা ও একজন সহকারী অধ্যাপক। বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ ক’জন শিক্ষক ও কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অধ্যাপক ( মনোবিজ্ঞানী) বাংলানিউজকে বলেন, কাউন্সেলিং অফিসার পদে আবেদন করতে হলে কমপক্ষে প্রার্থীকে মনোবিজ্ঞান বিষয়ের উপর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর হতেই হবে। পাশাপাশি কমপক্ষে দেড় থেকে দুই বছরের অভিজ্ঞতাও থাকতে হবে। এমনকি ক্লিনিক্যাল সাইক্লোলজির ওপর মার্স্টার্স করা থাকলেও ডিপ কাউন্সেলিং করা পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সমাজকর্ম বিষয়ে পড়াশোনা করা একজন কী করে এপদে কাজ করবেন!
এই পদে কাজ করতে হলে মনোবিজ্ঞানে পড়াশোনা অত্যাবশ্যক। অথচ উপাচার্যের আত্মীয়া রিফাত জেরিনের নিয়োগ স্থায়ী করতেই যোগ্যতার শর্ত শিথিল করে সমাজকর্মকেও রাখা হয়েছে। সমাজকর্মের ডিগ্রি এই পদে কাজ করতে কোনো কাজেই লাগবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ৪২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী জায়েদা আক্তার বলেন, যিনি কাউন্সেলিং করাবেন তিনি যদি এই বিষয়ে পড়াশোনা না করে থাকেন, যদি পারদর্শী বা যোগ্য না হন তাহলে তাকে নিয়োগ দিয়ে কী লাভ! আমরা চাই যার এ বিষয়ে ডিগ্রি আছে এমন পারদর্শী একজনকেই নিয়োগ দেয়া হোক। যাতে করে আমরা আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান তার মাধ্যমে করতে পারি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৯ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন তার পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়দের মধ্য থেকে বেশ ক’জনকে নিয়োগ দিয়েছেন। তার আপন ভাতিজা আশরাফুল আলমকে প্রশাসনিক অফিসার পদে, আপন শ্যালিকা রুমানা পারভীনকে জাবি স্কুল অ্যান্ড কলেজের লেকচারার পদে, নিজের মেয়ে নাবিলা নুজহাতকে অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক পদে, বাসার কাজের বুয়ার এক ছেলেকে (স্বপন) খালেদা জিয়া হলের গার্ড পদে, স্বপনের স্ত্রীকে চতুর্থ শ্রেণীর পদে সুফিয়া কামাল হলে এবং বুয়ার অপর ছেলেকে শেখ হাসিনা হলে ঝাড়ুদার পদে নিয়োগ পাইয়ে দেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, এসব নিয়োগের সবগুলোই অ্যাডহক (অস্থায়ী) ভিত্তিতে দেওয়া। বর্তমান উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. আমির হোসেন দায়িত্ব নেবার আগ পর্যন্ত চতুর্থ শ্রেণীর নিয়োগ ছাড়া বাকি নিয়োগ কমিটিতে পদাধিকার বলে ছিলেন অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন। অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন আগে প্রশাসনিক দিকটিও দেখতেন। তখনই এসব বিতর্কিত নিয়োগের ঘটনা ঘটে।
আসলে কর্মকর্তা পদের সব নিয়োগেই উপ-উপাচার্য দায়িত্বে থাকেন। আর চতুর্থ শ্রেণীর নিয়োগ(যেমন-গার্ড) কমিটির দায়িত্বে থাকেন কোষাধ্যক্ষ। প্রতিটি কমিটিতেই সংশ্লিষ্ট অফিসপ্রধান এবং জাবি রেজিস্ট্রার আবু বকর সিদ্দিক থাকেন। এর বাইরে এক্সপার্টরাও থাকেন। ]
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য প্রয়াত পূর্ণেন্দু গাইন নিজে নিয়োগ কমিটিতে থেকে গণিত বিভাগে তার স্ত্রীকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এজন্য তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য জিল্লুর রহমান তাকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেন বলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান।
এ বিষয়ে দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, অ্যাডহক নিয়োগ বেশি দেওয়া মানে স্বজনপ্রীতির আশংকা বেড়ে যাওয়া। এসবের ফাঁক গলে অযাগ্যরা চলে আসে। এজন্য এই ধরনের যতো নিয়োগ হয়েছে, সেগুলোতে যোগ্যরা এসেছেন কিনা, সেটা খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
রিফাত জেরিনের যোগ্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ছাত্রকল্যাণ ও পরামর্শদানকেন্দ্রের পরিচালক ও ভাইভা বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক রাশেদা আখতার বলেন, আমি ক্যাম্পাসের বাইরে আছি।
তিনি এ বিষয়ে পরে কথা বলবেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
ভাইভা বোর্ডের সভাপতি উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. আমির হোসেন বলেন, জেরিনের যোগ্যতা সম্পর্কে এখনো আমি জানি না।
এ বিষয়ে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন বলেন, নিয়োগ কমিটিতে যারা রয়েছেন তারাই জেরিনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। আমার এর বেশি কিছু বলার নেই।
জেরিন তার আত্মীয়া কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হতেও পারে!’
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৭
জেএম/