ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

শিক্ষক নিয়োগ: রাবির উপ-উপাচার্যের অডিও ফাঁস!

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০১৯
শিক্ষক নিয়োগ: রাবির উপ-উপাচার্যের অডিও ফাঁস! রাবির উপ-উপাচার্য চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া। ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহী: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে প্রভাষক নিয়োগে নির্বাচনী বোর্ডের এক আবেদনকারীকে টাকার বিনিময়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়া নিয়ে উপ-উপাচার্য চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়ার কথোপকথন ফাঁস হয়েছে। আবেদনকারীর স্ত্রীর সঙ্গে উপ-উপাচার্যের দর-কষাকষির ওই অডিওতে টাকার বিষয়ে কথা বলতে শোনা যায়।

জানা যায়, সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে তিনটি প্রভাষক পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। এতে নুরুল হুদা নামে একজন আবেদন করেন।

তার স্ত্রীও আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। ফাঁস হওয়া অডিওতে তাকে উপ-উপাচার্য জাকারিয়ার সঙ্গে কথা বলতে শোনা যায়।  

আইন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আবেদনকারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নুরুল হুদা স্নাতকে সিজিপিএ ৩.৬৫ ও স্নাতকোত্তরে ৩.৬০ পান। আইন অনুষদে সেরা হওয়ায় ২০১৭ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক ও ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পান। তার বাড়ি উপ-উপাচার্য জাকারিয়ার এলাকা লালমনিরহাটে।

বিজ্ঞপ্তি দেখে আইন বিভাগের তিনটি প্রভাষক পদের বিপরীতে আবেদন করেন মোট ৪১ জন। তাদের মধ্যে নয়জনের স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে সিজিপিএ ৩.৫০ বা এর উপরে ফলাফল রয়েছে। অন্যদিকে, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ৩৩জন আবেদনকারীর ফলাফল ৩.৫০ বা এর উপরে।

২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ নভেম্বর সিন্ডিকেট সভায় নিয়োগ অনুমোদিত হয় ও এর পরের দিন ১৮ নভেম্বর নিয়োগপ্রাপ্তরা বিভাগে যোগ তেন। তবে, বিশেষ কৃতিত্বপূর্ণ ফল অর্জনের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক পেলেও আইন বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ হয়নি নুরুল হুদার।

নিয়োগের নির্বাচনী বোর্ডে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া ছিলেন বলেন জানিয়েছেন আইন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল হান্নান।  

তিনি বলেন, নিয়োগ বোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য রুস্তম আলী ও বিভাগের সভাপতি হিসেবে আমি উপস্থিত ছিলাম। এছাড়া, বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহজাহান মণ্ডল ছিলেন।

ফাঁস হওয়া ফোনালাপটি এখানে তুলে ধরা হলো:

উপ-উপাচার্য: হ্যাঁ, তুজ সাদিয়া। আমি প্রফেসর জাকারিয়া, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর।

চাকরিপ্রত্যাশীর স্ত্রী: আসসালামু আলাইকুম, স্যার।

উপ-উপাচার্য: ওয়ালাইকুমুস সালাম। আচ্ছা মা, একটা কথা বলো তো। আমার খুব শুনতে ইচ্ছা, তোমরা কয় টাকা দেওয়ার জন্য রেডি।

চাকরিপ্রত্যাশীর স্ত্রী: স্যার, সত্যি কথা বলতে...

উপ-উপাচার্য: না না, সত্যি কথাই তো বলবা। উপরে আল্লাহতায়ালা, নিচে আমি।

চাকরিপ্রত্যাশীর স্ত্রী: অবশ্যই, অবশ্যই। স্যার, আপনি যেহেতু তার অবস্থা জানেন, আরেকটা বিষয় এখানে স্যার, সেটা হচ্ছে, আপনি হুদার... মানে, এমনিতে সে কতটা স্ট্রিক প্রিন্সিপালের..., আপনি বোধহয় এটাও জানেন স্যার, একটু রগচটা ছেলে।

উপ-উপাচার্য: আচ্ছা রাখো রাখো, এখান থেকে কথা বলা যাবে না।

নিয়োগের জন্য টাকা নিয়ে দর-কষাকষির বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, এসব সাজানো। এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবো না। আমি আজ থেকে ফোনে কোনো কথা বলবো না।

এদিকে, এ নিয়োগ প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ ও সাজানো নাটক বলছেন খোদ নিয়োগ বোর্ডের সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্যরা।

নিয়োগের নির্বাচনী বোর্ডের সদস্য ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহজাহান মণ্ডল বলেন, আমি যখন নির্বাচনী বোর্ডে অংশ নিতে যাই, তখন ওই বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক আমাকে সতর্ক করেছিলেন। এই নিয়োগে আর্থিক লেনদেন হতে পারে বলে তারা জানিয়েছিলেন।  

আবেদনকারী নুরুল হুদার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আমি এ বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত। এ নিয়ে আমি কোনো কথা বলবো না।  

নুরুল হুদার স্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিন্ডিকেট সদস্য বলেন, আইন বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদিত হওয়ার সময় আমি ছিলাম। এ নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ ও অস্বচ্ছ। আমার কাছে সবই সাজানো নাটক মনে হয়েছে। আগে থেকে সবই নির্ধারিত ছিল, কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইন বিভাগের এক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক বলেন, প্রভাষক নিয়োগে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা লেনদেনের একটি তথ্য আমার কাছে এসেছিল। যেদিন নিয়োগ বোর্ড বসে, সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যপন্থি এক শিক্ষক এক আবেদনকারীকে নির্বাচন বোর্ড পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন। কিন্তু, অ্যাকাডেমিক ফল খারাপ হওয়ায় সে প্রার্থীর নিয়োগ হয়নি।

প্রশ্নবিদ্ধ এ নিয়োগ বাতিলের সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে আছে কি-না জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, সিন্ডিকেটে নিয়োগ বাতিল করার প্রক্রিয়া জটিল। কারও নিয়োগ বাতিল করতে হলে কিছু অযোগ্যতা বিবেচনায় আনা হয়। কিন্তু, এক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ ধরনের পরিস্থিতি আগে কখনও সৃষ্টি হয়নি। এখন এই নিয়োগ বাতিলের প্রক্রিয়ার দিকে যেতে চাইলে করণীয় কী হবে, তা নিশ্চিত নই।

এ বিষয়ে জানতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহানের মোবাইলে একাধিবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।  

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০১৯     
এসএস/একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।