ঢাকা: ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভূত আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা দেশের উচ্চশিক্ষা প্রসারের অন্যতম অংশীদার ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব মহল এবং শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে।
বাজেট ঘোষণার পরদিন শুক্রবার (০৪ জুন) বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছে।
এতে বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী ট্রাস্টের অধীনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত। ট্রাস্ট আইন ১৮৮২ অনুযায়ী ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত হওয়ায় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান করযোগ্য নয়।
কোম্পানি আইন ১৯৯৪ এর আওতায় লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সঙ্গে ট্রাস্ট আইনে অলাভজনক হিসেবে পরিচালিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর একই আওতায় সমভাবে আয়কর আরোপের প্রস্তাবনা আইনের পরিপন্থী এবং কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
শিক্ষাখাতকে অতিব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় সরকার এ খাতে প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা তথা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার সব স্তরে বিপুল অংকের ভর্তুকি ও অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জাতীয় বাজেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নামমাত্র খরচে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার সুযোগ পায়।
অন্যদিকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনো প্রকার সরকারি বরাদ্দ কিংবা অনুদান না পাওয়ার কারণে এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি’র ওপর নির্ভর করতে হয়। একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে সরকার যেখানে মেধা সৃষ্টির লক্ষ্যে সর্বস্তরের শিক্ষাখাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিয়ে থাকে, সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর করারোপ করা হলে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে তা ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি করবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার ব্যাপক প্রসার তথা শিক্ষিত জাতি গঠনের লক্ষ্যে দেশের শিক্ষানুরাগী-উদ্যোক্তারা ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থলগ্নির মাধ্যমে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে দেশে ১০৭টি অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী একসঙ্গে বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে এবং শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গমনের প্রবণতা হ্রাসের পাশাপাশি মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় ও মেধা পাচার রোধ করা সম্ভব হয়েছে। উপরন্তু অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার জন্য বাংলাদেশে আসছে এবং মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। তদপুরি, দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশে বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নতুন উদ্যোক্তা ও পেশাজীবী তৈরিসহ বিশাল জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তর করার মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে।
এতে বলা হয়, বর্তমান করোনা দুর্যোগকালে সময়ে অর্থ সংকটে পতিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করছে। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ক্যাম্পাস ভাড়া দেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একমাত্র অর্থ প্রাপ্তির উৎস হিসেবে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফিসও নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া এইচএসসি পরীক্ষা সময়মত না হওয়ার কারণে শিক্ষার্থী সংকটও দেখা দিয়েছে। অধ্যায়ণরত শিক্ষার্থীদের বৃত্তি ও টিউশন ফিসের ওপর ছাড় দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। এ সময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর কর আরোপ করা হলে বিশেষ করে অনুমোদিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এ কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর কর আরোপ না করে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে প্রার্থিত প্রণোদনা দেওয়ার মাধ্যমে সরকার সহায়তার হাত প্রসারিত করবে বলে আশা করি।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ট্রাস্টের অধীন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় ট্যাক্স-ভ্যাট প্রযোজ্য নয়। বিধায় এর আগে ২০১৫ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হলে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে তা রহিত করা হয়। ২০১০ সালে এসআরও এর মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর কর ধার্য করা হলে হাইকোর্ট কর্তৃক ট্রাস্ট আইনে পরিচালিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর কর আরোপের বিষয়টি স্থগিত রয়েছে। অতঃপর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর নতুন করে কর আরোপের প্রস্তাব বর্তমানে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে পৃথিবীর বহু দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো লাভজনক এবং অলাভজনক উভয় পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়ে থাকে এবং সেক্ষেত্রে লাভজনক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকার যেমন রাজস্ব আদায় করে, তেমনি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হন এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার তথা দেশকে সহায়তা করেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী ট্রাস্টের অধীন পরিচালিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর আরোপ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিক সংকটে পড়বে এবং সেইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির কারণে উচ্চশিক্ষা অর্জন বাধাগ্রস্থ হবে এবং শিক্ষিত জাতি গঠনের মাধ্যমে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর রূপকল্প ২০৪১ অর্জনের লক্ষ্য ব্যাহত হবে।
উচ্চ শিক্ষার মাধ্যমে আগামী দিনের মানসম্পদ উন্নয়নে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান তথা বিপুল সংখ্যক কর্মচারী-কর্মকর্তা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অস্তিত্ব রক্ষার বিবেচনায় বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির পক্ষ থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর কোনো প্রকার কর আরোপ না করার জোড় সুপারিশ করছি এবং করোনা দুর্যোগের এই সংকটাপন্ন সময়ে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারিভাবে অনুদান-প্রণোদনা দিতে জোড় দাবি জানাচ্ছি।
বাংলাদেশ সময়: ২২২৯ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০২১
এমঅাইএইচ/এসআই