ফেনী: দ্বীপ হাতিয়া থেকে ফেরার পথে সি-ট্রাকের ডেকে দেখা হয় রনির সঙ্গে। চিপ চিপে গড়নের শ্যামলা বর্ণের কিশোর রনি সি-ট্রাকে মানুষের মালপত্র উঠা-নামানোর কাজ করে।
রনি জানায়, সে হাতিয়ার সোনাদিয়া ইউনিয়নের পূর্ব চরচেঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণিতে পড়তো। দেশে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই এ কাজে নেমেছে। এখন এটাই তার এক কাজ। সারাদিনে ১শ থেকে দেড়শ টাকা যাই আয় হয় তা তুলে দেয় মায়ের হাতে।
স্কুল খোলার কথা শুনে রনি বলে ‘আর স্কুলে যাইতাম হাইত্তান্ন কামে ডুকি গেছি, বাপে আর স্কুলে যাইতো দিতোনো’ (ভাই- আর স্কুলে যেতে পারবোনা কাজে ডুকে গেছি, বাবা আর স্কুলে যেতে দিবে না)।
একদিকে ব্যাপক সমারোহে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি চলছে অন্যদিকে স্কুল থেকে ছিটকে পড়া এমন হাজারো শিশু-কিশোরের দীর্ঘশ্বাস বাড়ছে। যেই হাতে বই-খাতা আর কলম থাকার কথা, করোনা ভাইরাস সে হাতে মানুষের মালপত্র তুলে দিয়েছে। স্কুলগামী একজন শিশুকে পরিণত করেছে কুলিতে। স্কুল থেকে সরে পড়া উপকূলের অধিকাংশ অসহায় শিশুর গল্পগুলো প্রায় একই রকম।
হাতিয়া উপজেলা সদর উছখালীর একটি হোটেলে নাস্তা করতে গিয়ে ফয়েল ইসলাম রিয়াদ নামের আরেক শিশুর সঙ্গে দেখা।
বয়স সাকুল্যে আট অথবা নয় হবে। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল স্থানীয় আফাজিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২য় শ্রেণিতে পড়তো সে। স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এখন এ হোটেলটিতে বেয়ারার কাজ করে। মাসে ১৫শ টাকা বেতনের পুরাটাই মায়ের হাতে তুলে দেয় এ শিশু।
রিয়াদ বলে, বাপে আরেকটা বিয়া করছে, আমগোর খোঁজখবর লয়না, হোটেলে কাম করি যা পাই মায়েরে দিয়া দেই’।
নলছিরা ঘাটে দেখা হওয়া কিশোর নিশান জানায়, সে চর কিং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণিতে পড়তো। এখন ঘাটে কুলির কাজ করে। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ হওয়ার পর থেকেই সে এ কাজে নেমেছে। সরা দিনে ১শ থেকে দেড়শ টাকা আয় করে। সেই টাকা তুলে দেয় বাবার হাতে।
হাতিয়া দ্বীপের কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয় এ বিষয়ে। তারা বলেন, যখন স্কুল ছিলো বাচ্চারা স্কুলে যেতো। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন তারা। এখন তারা কাজ শিখে গেছে, তাতে আয়ও হচ্ছে। আর সে কারণেই তারা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চাইছেন না। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের (বিআইজিডি) ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯ ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত এই জরিপ পরিচালিত হয়।
এ বিষয়ে কথা হয় হাতিয়ার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ কেফায়েত উল্লাহর সঙ্গে। তিনি বলেন, শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলেই হবে না। দ্বীপ ও উপকূলীয় এলাকার অনেক শিক্ষার্থী গরিব ও অসহায়। দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকার কারণে অনেক শিক্ষার্থী স্কুল থেকে দূরে সরে গেছে। অনেকে কাজে জড়িয়ে পড়েছে। এসব শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরাতে হলে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজন আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরানোর কর্মসূচি নিতে হবে। সেসঙ্গে এনজিওগুলোও শিশুদের স্কুলে ফেরাতে বিভিন্নভাবে পদক্ষেপ নিতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২১
এসএইচডি/এএটি