ঢাকা, বুধবার, ১৬ আশ্বিন ১৪৩১, ০২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

নির্বাচন ও ইসি

কমিশন না থাকায় রায় পেলেও শাহাদাতের চেয়ারে বসা অনিশ্চিত

ইকরাম-উদ দৌলা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০২৪
কমিশন না থাকায় রায় পেলেও শাহাদাতের চেয়ারে বসা অনিশ্চিত

ঢাকা: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনের সাড়ে তিন বছর পর নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল বিএনপির প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে রায় দিলেও কমিশন না থাকায় এখনই গেজেটে প্রকাশ করতে পারছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এক্ষেত্রে আদালতের বেঁধে দেওয়ার ১০ দিন সময় তো দূরের কথা অন্তত এক মাসের মধ্যেও গেজেট প্রকাশ নিয়ে রয়েছে আইনি জটিলতা।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রাইব্যুনাল ইসি গঠন করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ইসি তো আর আপিল করতে পারেন না। এখন নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য ৩০ দিন সময় রয়েছে। আপিলের সময় পর্যন্ত ইসি গেজেট প্রকাশ করতে পারেন না। কেননা, আপিলের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে বিবাদীপক্ষ বা সংক্ষুব্ধ কোনো পক্ষ যদি আপিল করেন তাহলে আপিল নিষ্পত্তির আগ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। অন্যদিকে কোনো ভোটের গেজেট প্রকাশ করতে হলে ফুল কমিশনের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। বিগত কমিশন পদত্যাগ করায় সে অনুমোদন নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই নতুন কমিশন নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত কেউ আপিল না করলেও গেজেট প্রকাশ করা যাবে না।

ইসির ব্যাখ্যা যেমন

ইসির আইন শাখার যুগ্ম সচিব ফারুক আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, এখন তো কমিশন নেই। কাজেই এখন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে পর্যালোচনা করে নিতে হবে। আবার কমিশন না থাকলেও যে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না, তা নয়। আদালত যদি আমাদের কাছে মতামত চায়, সেক্ষেত্রে আমরা বলবো যে গেজেট প্রকাশ করতে হলে কমিশনের অনুমোদন লাগে। এছাড়া যেহেতু রায় হয়েছে আমরা মতামত না চাইলেও মতামত দিতে পারি। উপদেষ্টা পরিষদের কাছেও করণীয় জানতে চাইতে পারি।
 
তিনি বলেন, আদালতের আদেশ যতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য ততটুকু বাস্তবায়ন করব। যেটা বাস্তবায়নযোগ্য না সেটা বাস্তবায়ন হবে না। পরিস্থিতি অনুযায়ী আমাদের কাছে রায়ের কপি এলে আমরা দেখব। এমন না যে আদালতের আদেশে, যেভাবে আদেশ দিয়েছেন সম্ভব না হলে সেভাবেই করতে হবে বিষয়টি এমন না। কমিশন নেই। এখন কমিশনের অনুমোদন আগ পর্যন্ত হয়তো আমরা উপদেষ্টা পরিষদ পর্যন্ত যেতে পারি। আর তারা তো আইন পরিবর্তন করতে পারবেন না। সংসদে যে পাস করা আইনে যে বিধান আছে, সেটা তারা পরিবর্তন করতে পারবেন না। তবে যেহেতু স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার ভেঙে দিয়েছে এবং সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে, এতে মনে হচ্ছে বিষয়টি বেশি একটা কাজে আসবে না। কারণ কমিশন থাকা অবস্থায়ও যদি এই আদেশ হতো, তাহলে কি হতো, ওই বাতিলের খাতায় তো পড়ে যেতো। এখন ওই পরিষদগুলোই তো বাতিল। সরকারের আদেশে যেহেতু বাতিল হয়েছে এই বিষয়টা অনেকটা ইনফ্রাকচুয়াস (অকেজো)। বড় কথা হলো গেজেট করতে হলে কমিশন লাগে। এখন কমিশন নেই। কমিশনের অনুমোদনের পরিবর্তে বিকল্প কি আছে সেটা আমাদের পর্যালোচনা করে দেখতে হবে।

মামলা তো সরকারের সিদ্ধান্তের আগে করা, সেক্ষেত্রে ইসির আইনি পদক্ষেপ কী হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আইন শাখার প্রধান বলেন, ইসির অনুপরিস্থিতিতে বিকল্প কি করা যেতে পারে তা পর্যালোচনা না করে বলা যাচ্ছে না। করণীয় বলতে সরকার যদি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতা দেয়, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আমরা আসলে কোনটি করবো সেটি পর্যালোচনা না করে বলা যাবে না। কমিশন না থাকায় এখন এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

ট্রাইব্যুনালের রায়

চসিক নির্বাচনের ফলাফল বাতিল চেয়ে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনের দায়ের করা মামলায় তাকে আজ মেয়র ঘোষণা করেন আদালত। একইসঙ্গে আগামী ১০ দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন সচিবকে গেজেট প্রকাশ করার জন্য নির্দেশ দেন। দুপুর ১২টায় নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল হিসেবে চট্টগ্রামের যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ খাইরুল আমীনের আদালত এ রায় দেন।

আইনজীবী কী বলছেন

ডা. শাহাদাত হোসেনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. মঈনউদ্দীন হোসাইন সোহেল আদালতের রায় তুলে ধরে বাংলানিউজকে বলেন, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা ২০১০ এর ৫৩(২) ধারা মতে মামলায় ডা. শাহাদাত হোসেনকে বিবাদীদের বিরুদ্ধে একতরফা সূত্রে বিনা খরচায় ডিক্রি দেওয়া হয়েছে। ওই আইনের ধারা ৫৯(খ) অনুসারে ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি সরকারের গেজেট অনুসারে চসিকের একই বছরের ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মেয়র হিসেবে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মো. রেজাউল করিম চৌধুরীকে নির্বাচিত ঘোষণা বাতিল করা হয়েছে। আইনের ৫৯(ক) অনুসারে এই মামলায় নির্বাচনে ধানের শীষের প্রতীকের প্রার্থী শাহাদাত হোসেনকে নির্বাচিত মেয়র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

মো. মঈনউদ্দীন হোসাইন সোহেল আরও জানান, আদালত আগামী ১০ দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন সচিবকে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী শাহাদাত হোসেনকে নির্বাচিত মেয়র হিসেবে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন।

মামলায় কী আছে

২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি চসিক নির্বাচনে কারচুপি ও ফল বাতিল চেয়ে মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নয়জনের নামে মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় বিবাদী করা হয়েছিল চসিকের সাবেক মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান, নির্বাচন কমিশনারের সচিব, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, আবুল মনজুর, এম এ মতিন, খোকন চৌধুরী, মুহাম্মাদ ওয়াহেদ মুরাদ, মো. জান্নাতুল ইসলামকে। আদেশের সময় তাদের পক্ষে আদালতে কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না।

মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে, নৌকা প্রতীক পাওয়ার পর থেকে চসিক কর্মকর্তারা রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে দিয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যায় নির্বাচনের নামে ওইদিন শুধু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে। যে কারণে নির্বাচনে ভোটের হিসাব চেয়ে এখনো পাওয়া যায়নি। কোনো কেন্দ্র থেকে ইভিএমের প্রিন্ট কপিও দেওয়া হয়নি। ভোটের দিন দুপুর পর্যন্ত ৪ থেকে ৬ শতাংশ ভোট পড়ে। কিন্তু ভোটের হিসাবে দেখানো হয়, ২২ শতাংশ ভোট পড়েছে।

নির্বাচন কবে হয়েছিল ও তার ফলাফল

২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চসিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঘোষিত ফলাফলে তিন লাখ ৬৯ হাজার ২শ ৪৮ ভোট পাওয়ায় নৌকার প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা অনুসারে, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেন ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছিলেন ৫২ হাজার ৪শ ৮৯ ভোট।

কেন্দ্রীয় বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেনকে ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপির পার্লামেন্টারি বোর্ডের বৈঠকের পর চসিক নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল।  
 
ট্রাইব্যুনাল আইনে কী আছে

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯, এ নির্বাচনী বিরোধ বিষয়ে বলা হয়েছে, এ আইনের অধীন নির্বাচন সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশন একজন উপযুক্ত পদমর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল এবং একজন উপযুক্ত পদমর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও একজন উপযুক্ত পদমর্যাদার নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তার সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাচনী আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করবে।

নিবার্চনী ফলাফল গেজেটে আকারে প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে উপধারা (১) এর অধীন গঠিত নিবার্চনী ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করা যাবে এবং নিবার্চনী ট্রাইব্যুনাল করপোরেশনের নিবার্চন সংক্রান্ত যেকোনো মামলা দায়ের করার ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করবে।

নিবার্চনী ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মামলার রায় ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে উপধারা (১) এর অধীন গঠিত নিবার্চনী আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল দায়ের করা যাবে এবং নিবার্চনী আপিল ট্রাইব্যুনাল করপোরেশনের নির্বাচন সংক্রান্ত যেকোনো আপিল দায়ের করার ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করবে। নির্বাচনী আপিল ট্রাইব্যুনালের রায় চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

কমিশন নেই কেন

৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একদফা দাবির মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ায় রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগ দেন। সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী সেই সময় শেষ হবে আগামী ৪ নভেম্বর।  

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয় কমিশন গঠনের ঘোষণা দেওয়ায় কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন পদত্যাগ করেন। তার আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ‌‘আলোচনার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না’ উল্লেখ করে পত্রিকায় লেখা এক কলামে সাংবিধানিক সংকট উত্তরণে বেসামরিক ফরমান জারি করার আহ্বান জানান।  

তিনি সেখানে বলেন, সংবিধানে উল্লিখিত মেয়াদের মধ্যে ভোটের আয়োজন না করলে নির্বাচন কমিশনের মৃত্যুদণ্ড হওয়ার বিধান রয়েছে। এরপর ৫ সেপ্টেম্বর তিনিসহ পুরো কমিশন পদত্যাগ করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০২৪
ইইউডি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।