অতীতে যে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছিল, তা থেকে দেখা যায়-প্রথমে দল তার কোনো সদস্যকে অব্যাহতি বা বহিষ্কার করে। আর সে অনুযায়ী, দলের পক্ষ থেকে স্পিকারকে সংশ্লিষ্ট এমপির পদ শূন্য করতে বিরোধ উত্থাপন করে।
২০০০ সালে জাতীয় সংসদে কিশোরগঞ্জ-২ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মো. আখতারুজ্জামানকে শৃঙ্খলা ভঙের অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি। এরপর তার আসনটি শূন্য ঘোষণার জন্য তৎকালীন স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে অনুরোধ করেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন।
স্পিকার সেই বিরোধটি নিষ্পত্তির জন্য চিঠি দেন সিইসিকে। নির্বাচন কমিশন সে সময় সংবিধানের ৬৬ (৪) দফা ও জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১৭৮ বিধি অনুযায়ী,আখতারুজ্জামানের সংসদ সদস্য পদ শূন্য ঘোষণা করে।
একই নিয়ম প্রয়োগ করা হয়েছিল, দশম সংসদের সাবেক ডাক, টেলিযোগযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধেও।
২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকী হজ নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করলে দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। প্রথমে ১২ অক্টোবর তাকে মন্ত্রিপরিষদ থেকে অপসারণ করা হয়। পরবর্তীতে ২৪ অক্টোবর তাকে প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও অব্যাহতি দেয় আওয়ামী লীগ।
>> সংসদ সদস্য পদও হারাচ্ছেন লতিফ সিদ্দিকী!
পরবর্তীতে ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই দলটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিরোধী উত্থাপনকারী হিসেবে স্পিকারকে লতিফ সিদ্দিকীর পদটি শূন্য ঘোষণার চিঠি দেন।
তিনি লেখেন- ২০১৪ সালে ২৪ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় দলের গঠতন্ত্রের ৪৬ (ক) এবং (ঞ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। যেহেতু তার আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যপদ নেই, সেহেতু তাকে জাতীয় সংসদ সদস্য পদেও বহাল রাখা সমীচীন হবে না।
সে মোতাবেকই সিইসিকে সংবিধানের ৬৬ (৪) দফা ও জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১৭৮ বিধি অনুযায়ী টাঙ্গাইল-৪ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকীর আসন সম্পর্কিত বিতর্ক নিষ্পত্তি করতে বলেন স্পিকার।
সংসদ সদস্য (বিরোধ নিষ্পত্তি) আইন ১৯৮০ অনুযায়ী, স্পিকার কোনো সংসদ সদস্যের আসন শূন্য ঘোষণার কোনো বিতর্ক সম্পর্কিত কোনো বিবৃতি ইসিকে পাঠালে এর চৌদ্দ দিনের মধ্যে তা বিরোধ উপস্থাপনকারী ও যার বিরুদ্ধে বিরোধ উপস্থাপন হয়েছে, উভয়পক্ষকে জানাতে হয়। এবং তাদের কোনো বক্তব্য থাকলে তাইসি নির্ধারিত সময়ে মধ্যে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং লতিফ সিদ্দিকীকে নিজ নিজ অবস্থান তুলে ধরার জন্য চিঠি দেন।
>> নিজ অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দিতে আশরাফুল-লতিফকে চিঠি
একই বছর ২ আগস্ট সৈয়দ আশরাফ সিইসিকে লেখেন- যেহেতু লতিফ সিদ্দিকী দলের কোনো পদে নেই, প্রাথমিক সদস্যও নন এবং দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে তাকে; সেহেতু আইনি ধারায় সংসদ সদস্য থাকার আইনগত অধিকারও হারিয়েছেন। তাই সংবিধানের ৬৬ (৪) ধারা, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে ১৯৭২-এর ১২ (১) অনুচ্ছেদ ও সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১৭৮ বিধি অনুযায়ী লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ বাতিল করার অনুরোধ জানাচ্ছি।
আর লতিফ সিদ্দিকী লেখেন- সংবিধানের ৬৬ (৪) দফায় বর্ণিত সারমর্মের সঙ্গে স্পিকারের পাঠানো বিতর্কটি সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তার ক্ষেত্রে সংবিধানের ৬৬ (৪), ৬৬ (২) ও৭০ ধারার কোনো ব্যত্যয় না ঘটায় ইসির করণীয় কিছু আছে বলে মনে হয় না।
দুই পক্ষের জবাব পেয়েছে নির্বাচন কমিশন ২৩ আগস্ট শুনানি করেন। এতে উপস্থিত হয়ে লতিফ সিদ্দিকী স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার ঘোষণা দেন। নির্বাচনকমিশন ওইদিন ৬ সেপ্টেম্বর পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন।
>> আশরাফ-লতিফের শুনানি ২৩ আগস্ট
ইসিতে শুনানিতে অংশ নেওয়ার জন্য আদালতে যান লতিফ সিদ্দিকী। কিন্তু ২২ আগস্ট উচ্চ আদালত বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য ইসির কাছেই পাঠান তাকে।
>> আপিল বিভাগের নো অর্ডার, ইসির শুনানিতে যাচ্ছেন লতিফ সিদ্দিকী
লতিফ সিদ্দিকীর তার ঘোষণা অনুযায়ী, দ্বিতীয় শুনানির আগেই ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনে অংশ নিয়ে স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। সংসদ সচিবালয় ৩ সেপ্টেম্বর তার পদটি শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে।
>> পদত্যাগ করলেন লতিফ সিদ্দিকী
নির্বাচন কমিশন তার পদত্যাগের পর নির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী, ৬ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় শুনানি করেন। এতে সৈয়দ আশরাফ তথা বাদী পক্ষের আইনজীবি উপস্থিত থাকলেও, লতিফ সিদ্দিকী বা তার পক্ষে কেউ উপস্থিত ছিলেন না।
নির্বাচন কমিশন পরবর্তীতে রায়ে লেখেন- ‘বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব আবদুল লতিফ সিদ্দিকী গত ১ সেপ্টেম্বর অপরাহ্নে পদত্যাগ করায় দশম সংসদের ১৩৩ টাঙ্গাইল-৪ আসনটি সেই তারিখে শূন্য হয়েছে মর্মে গেজেট সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশিত হওয়ায় এবং ওই গেজেট নির্বাচন কমিশন পাওয়ায় বিচার্য বিষয় ইতিমধ্যে নিষ্পন্ন হয়ে গেছে বিধায় মাননীয় স্পিকার কর্তৃক কমিশনের কাছে প্রেরিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদানের আর কিছু নেই। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সকলে অবিলম্বে অবহিত করা হোক। ’
ইসির যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিএনপির বিরোধ উত্থাপনের কারণে ২০০০ সালে আখতারুজ্জামানকে এমপি পদ হারাতে হয়েছিল। লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়টিও একই প্রক্রিয়ায় গিয়েছিল। তবে তিনি পদত্যাগ করায় তার পদ নিয়ে আর সিদ্ধান্ত দিতে হয়নি ইসিকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলছেন, সংবিধানের ৬৬ (৪) দফা অনুযায়ী, বিরোধ সৃষ্টি হলে তা নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সংবিধান ৬৬ (২) অনুযায়ী, এমপি পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন কিনা এবং ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে আসন শূন্য হবে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলেই কেবল নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
সংবিধানে ৬৬ (২) অনুযায়ী, এমপি পদে থাকার অযোগ্যতা হলো-আদালত অপ্রকৃতস্থ ঘোষণা, দেউলিয়া হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি না পাওয়া, বিদেশী রাষ্ট্রের আনুগত্য ঘোষণা এবং নাগরিকত্ব অর্জন ও নৈতিকস্খলনের কারণে ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ২ বছরের কারাদণ্ড পেলে এবং সাজাভোগের পর পাঁচ বছর পার না হওয়া।
আর সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-কোনো দল থেকে নির্বাচিত হয়ে, সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দিলে এবং ওই দল থেকে পদত্যাগ করলে সংশ্লিষ্ট এমপির পদটি শূন্য হবে।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, দল থেকে বহিষ্কারের কথা এ দু’টি দফায় বলা হয়নি। কিন্তু এই দুই দফার বিতর্ক নিয়ে যখন ইসিতে নিষ্পত্তির জন্য চিঠি এসেছিল, ২০০০ সালে তানিষ্পত্তি করে আখতারুজ্জামানের পদটি শূন্য ঘোষণার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল ইসি। আর এই নজিরের বলেই জাহিদুর রহমানের পদও থাকবে না, যদি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সিইসির কাছে চিঠি পাঠান স্পিকার। তবে স্পিকার চিঠি না পালানে সংশ্লিষ্ট দল বা ব্যক্তিকে আদালতে যেতে হবে।
সংসদে আসবেনা এমন দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বিএনপির টিকিটে নির্বাচিত জাহিদুর রহমান গত ২৫ এপ্রিল শপথগ্রহণ করেন। এরপর ২৭ এপ্রিল দলের সব পর্যায় থেকে তাকে বহিষ্কার করে বিএনপি। তাই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠেছে জাহিদুর রহমানে এমপি পদ থাকবে কি না?
বাংলাদেশ সময়: ২৩০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০১৯
ইইউডি/এসএইচ