ঢাকা: নরসিংদীর প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেন হয়ে উঠেছিলেন গণমানুষের নেতা। জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থেকে বিএনপি ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত নরসিংদীর পৌর নির্বাচনে নিবাচিত হন বিপুল ভোটে।
নরসিংদীর উন্নয়ন আর মানুষের সেবায় যিনি ছিলেন সারাক্ষণ ব্যস্ত। নরসিংদীর সেই জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি, যিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছিলেন, সেই খুনি আশরাফ হোসেন সরকারই পেলেন নরসিংদী পৌর নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নৌকার প্রতীক।
গত বুধবার রাতে প্রধানমন্ত্রী বাসভবন গণভবনে স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভায় নরসিংদী পৌরসভায় মেয়র পদে আশরাফ হোসেন সরকারকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। নরসিংদীর জনপ্রিয় মেয়র লোকমানকে যার পরিকল্পনায় হত্যা করা হয়েছিল সেই খুনি আশরাফকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় জেলা এবং শহর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসগঠনের নেতাকর্মী-সমর্থকসহ সাধারণ মানুষ হতবাক-ক্ষুদ্ধ।
ওই ঘটনার পর বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছে আশরাফ হোসেন সরকারের মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগ, পৌর আওয়ামী লীগসহ সব সহযোগী সংগঠনের জেলার সভাপতি-সম্পাদক। তারা লিখিত আবেদন করেছেন। তৃণমূলের সিদ্ধান্ত বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের ছোট ভাই বর্তমান মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. কামরুজ্জামানকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান ওই চিঠিতে। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, জনপ্রিয় নেতা ছিলেন লোকমান হোসেন, নরসিংদীর উন্নয়নে যার বিশাল ভূমিকা। জামায়াত বিএনপির অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন যিনি। আওয়ামী লীগের প্রিয় নেতা লোকমান হত্যার খুনি কীভাবে পৌর নির্বাচনে মনোনয়ন পায় বুঝি না। যিনি একাধিক মামলার আসামি, দলীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যার একযুগ ধরে সম্পর্ক নেই। সেই ব্যক্তির মনোনয়ন দলীয় নেতাকর্মীসহ তৃণমূলের সমর্থকরা মেনে নিতে পারছেন না। আওয়ামী লীগ সব সময় সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ আর দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় আর সেই আওয়ামী লীগ থেকে যদি আশরাফের মতো খুনিরা পুরস্কৃত হয় তাহলে শুধু নরসিংদীবাসীই নয়- সারাদেশের মানুষের জন্য ভুল মেসেজ যাবে।
নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুকন্যাকে ভুল তথ্য দিয়ে এই মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ করছেন।
জানা যায়, জেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে তিনজন প্রার্থীর নাম পাঠানো হয় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রে। এক নম্বরে ছিল নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল। যিনি প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের ছোট ভাই। তালিকায় দুই নম্বরে ছিল শহর আওয়ামী লীগের সাধরণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন বাচ্চু ও তিন নম্বরে ছিলেন শহর আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান। কিন্তু আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মকাণ্ডে ছিল না তার কোনো সম্পৃক্ততা। যিনি দলের কোনো পদেও ছিলেন না দীর্ঘদিন। সেই বিতর্কিত এবং জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তি আশরাফ সরকার নৌকার মনোনয়ন পাওয়ায় দলের ভেতরেই তীব্র অসন্তোষ চলছে। আশরাফ সরকারের মনোনয়ন বাতিল করে দলের যোগ্য এবং তৃণমূলের মতামত গুরুত্ব দিয়ে প্রার্থী দেওয়ার জন্য দলের নেত্রীর কাছে আবেদন জানান দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকরা।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলছেন, আমরা আওয়ামী লীগ মনেপ্রাণে করি। আর একজন জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতার খুনির জন্য মানুষের কাছে ভোট চাইতে যাবো কীভাবে? যার হাতে লোকমানের রক্তের দাগ লেগে আছে, তার হাতে হাত মেলাবো কীভাবে? আমাদের নেত্রী বিষয়টি বিবেচনা করে লোকমানের ভাই বর্তমান মেয়র কামরুজ্জামান কামরুলকে মনোনয়ন দিলে নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত হবে।
লোকমান হত্যা মামলা
২০১১ সালের ১ নভেম্বর পৌর মেয়র লোকমান হোসেনকে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ হত্যার ঘটনায় নিহতের ছোট ভাই বর্তমান মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান কামরুল বাদী হয়ে ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা করেন। ওই ঘটনায় আশরাফ হোসেন সরকারকে গ্রেফতার করা হলে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তৎকালীন জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ মন্ডল প্রায় দীর্ঘ ৮ মাস তদন্ত শেষে ২০১২ সালের ২৪ জুন সালাহউদ্দিনসহ এজাহারভুক্ত ১১ আসামিকে বাদ দিয়ে ১২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। এদের মধ্যে মামলার এজাহাভুক্ত তিনজন এবং হত্যার পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে নয়জন আসামির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এজাহারভুক্ত তিন নম্বর আসামি শহর আওয়ামী লীগের সাবেক কোষাধ্যক্ষ মোবারক হোসেন, এজাহারভুক্ত দুই নম্বর আসামি নরসিংদী পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি আবদুল মতিন সরকার, তার ছোট ভাই শহর যুবলীগের সাবেক সভাপতি আশরাফ হোসেন সরকারসহ ১২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
আদালতে দাখিল করা চার্জশিটে বলা হয়, নাজমুল হাসান ওরফে কিলার শরীফ সরাসরি হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করে ৩০২ ধারার এবং হত্যার পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করে মোবারক হোসেন ওরফে মোবা, আশরাফুল ইসলাম সরকার, আবদুল মতিন সরকার, হাজি ফারুক ও শাহিন মিয়া ১২০(খ) ধারার অপরাধে সংশ্লিষ্ট থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া অভিযুক্ত বাকি আসামি হাজি সেলিম, আওলাদ হোসেন, শিবলী সরকার ওরফে ইশু সরকার, হিরু, মাহফুজুর রহমান ওরফে সবুজ সরাসরি হত্যার উদ্দেশ্যে সহযোগিতা করে দণ্ডবিধির ৩৪ ধারার এবং হত্যার আলামত নষ্ট করার চেষ্টা করে আসামি সারোয়ার হোসেন ২০১ ধারার অপরাধ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পীরজাদা কাজী মো. আলী বলেন, লোকমান হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। সেই কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আমি এখনও দায়িত্ব পালন করছি। এখন সেই আমি কী করে লোকমানের খুনি আশরাফ সরকারের জন্য মানুষের কাছে ভোট চাইতে যাবো? আমাদের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এ ঘটনায় ধিক্কার দিচ্ছে, কোনোভাবেই মেনে নিচ্ছে না।
‘আশরাফের মনোনয়ন বাতিল করে অন্য মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানিয়ে নেত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছি, আশা করছি আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের চাওয়া পূরণ করবেন। একজন খুনিকে দলের মনোনয়ন দেওয়া কেউ কামনা করে না। ’
নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন বাচ্চু বলেন, আশরাফ হোসেন সরকারের মতো একজন খুনিকে নৌকার প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ায় আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা হতবাক এবং ক্ষুদ্ধ। তার এই মনোনয়ন পরিবতনের দাবি জানিয়ে আমরা কেন্দ্রেও চিঠি দিয়েছি। শুধু খুনিই নয়, যিনি গত ১০ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগের কোনো দলীয় পদে নেই, কোনো কর্মসূচিতেও দেখা যায়নি জনবিচ্ছিন্ন খুনি সেই আশরাফ কীভাবে মনোনয়ন পেলেন আমরা ভেবে পাই না।
জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান শামীম নেওয়াজ বলেন, আমার ভাইকে যিনি হত্যা করলেন, আদালতে স্বীকারোক্তিও তিনি দিলেন, চার্জশিটও হলো, সেই খুনি এখন নৌকার মার্কা পেলেন। আর আমি এখন জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে তার জন্য আমার ভোট চাইতে হবে! আমাদের নেত্রী নিশ্চয়ই বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবেন।
জেলা শ্রমিকলীগের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, আশরাফ সরকার ২০ বছর ধরে দলের সঙ্গে নেই। এমন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে মেনে নিতে পারি না। আমরা নিশ্চিত বঙ্গবন্ধুকন্যা আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী একজন খুনিকে মনোনয়ন দিতে পারে না, এটা কেউ ভুল তথ্য দিয়ে করিয়েছেন। নরসিংদীর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল। তিনি নরসিংদীর প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলার বাদীও। তিনি বলেন, আমার ভাই হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হচ্ছেন আশরাফ সরকার। আর ওই মামলার বাদী আমি। এখন আমি আওয়ামী লীগ করি, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি। এখন ভাই হত্যার বিচার চাইবো নাকি নৌকার প্রার্থী সেই ভাইয়ের খুনির জন্য ভোট চাইবো?
বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২১
এএ