ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নির্বাচন ও ইসি

ইউপি নির্বাচন

নৌকার মনোনয়ন পেতে টাকার ছড়াছড়ি!

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২১
নৌকার মনোনয়ন পেতে টাকার ছড়াছড়ি!

সিলেট: নৌকা পেলেই যেন বিজয় নিশ্চিত, জয়ের বন্দরে নোঙর ফেলতে চাই নৌকা—এমন বিশ্বাস এখন তৃণমূলে। তাই ইউপি নির্বাচনেও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা মাঠ গোছানোর চেয়ে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করতে জোর দিচ্ছেন বেশি।

এ জন্য তৃণমূলের ভোট বাগিয়ে নিতে কোনো কোনো প্রার্থী খরচ করছেন কাড়ি কাড়ি টাকা! টাকার জোর না থাকায় মনোনয়ন বঞ্চিত হচ্ছেন ত্যাগী নেতারা। আর টাকার জোরে তৃণমূলের ভোট কিনে নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নৌকার প্রার্থী হচ্ছেন সুবিধাভোগীরা। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের আর্থিক লেনদেনের এমন কিছু অডিও-ভিডিও বাংলানিউজের হাতে এসেছে।

সম্প্রতি কোম্পানীগঞ্জের একটি ইউনিয়নে সাবেক শিবির নেতা ইকবাল হোসেন ইমাদকে নৌকার মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয় সিলেটে। তার বিরুদ্ধে তৃণমূলের ভোট কেনার অভিযোগ তোলেন নেতাকর্মীরা। তারপরও প্রার্থী নির্বাচনে তৃণমূলের ভোটের মূল্য দিতে গিয়ে বিতর্কিত প্রার্থীর হাতেই নৌকা প্রতীক তুলে দেয় আওয়ামী লীগ।

এই বিতর্কের অবসান ঘটার আগেই আবারো মনোনয়ন দৌড় নিয়ে বিতর্ক উঠলো সিলেটে। গত সোমবার (১৮ অক্টোবর) দক্ষিণ সুরমার স্থানীয় একটি কমিউনিটি সেন্টারে দক্ষিণ সুরমা উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিতসভা অনুষ্ঠিত হয়। পরে গোপন ব্যালট দিয়ে তৃণমূলের ভোটের মাধ্যমে দক্ষিণ সুরমার ৫টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্ধারণ করা হয়। এরমধ্যে লালাবাজার ও দাউদপুর ইউনিয়নের প্রার্থী বাছাইয়ে ত্যাগী নেতাদের উপেক্ষা করে টাকার বিনিময়ে ভোট কিনে মনোনয়ন দৌড়ে তৃণমূলে এগিয়ে যান দুই প্রার্থী। লালাবাজার ও দাউদপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ার‌ম্যান পদে আগের রাতে টাকার বিনিময়ে ভোট কেনার অভিযোগ উঠেছে। রাতের আঁধারে টাকা লেনদেনের একটি ভিডিও ও একটি অডিও বাংলানিউজের কাছে এসে পৌঁছেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্ধিত সভার আগের রাতে তৃণমূলের অনেক কাউন্সিলরদের হাতে মোটা অংকের টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়। দাউদপুর ইউনিয়নেও দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কথোপকথনেও শোনা যায়, নৌকা পেতে কাউন্সিলরদের আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি। একই রাতে লালাবাজার ইউনিয়ন পরিষদে জনৈক প্রার্থী এক কাউন্সিলরের হাতে টাকার বান্ডিল তুলে দেন, ভিডিওচিত্রে এমনটি দেখা যায়।

অন্যদিকে টাকার বিনিময়ে নৌকার মাঝি হওয়া নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে তৃণমূল আওয়ামী লীগে। দক্ষিণ সুরমার লালাবাজার ইউনিয়নে তৃণমূলে জয় পেয়েছেন আসাব আহমদ। তিনি পেয়েছেন ৬ ভোট। বুলবুল আহমদ পেয়েছেন ৫ ভোট, মুহিদ হোসেন ৫ ভোট, তুয়াজিদুল হক তুহিন পেয়েছেন ৪ ভোট। এছাড়া দাউদপুর ইউনিয়নে আতিকুল হক ১০ ভোট, মনসুর আহমদ ৯ ভোট, মৌলানা মিজানুর রহমান ১ ভোট পেয়েছেন।

দাউদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী মিজানুর রহমান ও মনসুর আহমদের কথোপকথনের একটি অডিওতে শোনা যায়, নৌকাপ্রত্যাশী  চেয়ারম্যান প্রার্থী মিজান ১৪ জনকে টাকা দিয়ে মাত্র এক ভোট পেয়েছেন। পক্ষান্তরে মনসুর পেয়েছেন মাত্র ৯ ভোট। ভোট না দেওয়ায় মিজান অন্যদের কাছ থেকে টাকা ফিরিয়ে এনেছেন।

টাকা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ওই প্রার্থী বলেন, ‘টাকা এমনে দিইনি, চ্যানেলে দিছি’। অপর প্রান্তের প্রার্থী বলেন, ‘আমার একটি ভোট ৫৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে গেছে। ’ কথোপকথনে বলা হয়, ‘সকালে আতিকুল যে পরিমাণ টাকা দিয়েছে। তা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। ’ কথোপকথনে ওই দুই প্রার্থীর একজন বলেন, ‘আলমাছ মিয়ায় ২০ হাজার টাকা দিছলাম। পরে ফেরত আনছি। বলেছি, আমারে ভোট দিছইনা, টাকাগুলো দিলাও। রাত ১২টার মধ্যে টাকা না দিলে সকালে পুরো ইউনিয়নের মানুষ শুনবেন। ’

তবে আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, তৃণমূলের জরিপের ওপর ভিত্তি করে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হচ্ছে। তৃণমূলের কাউন্সিলররা যাকে মনোনীত করে দেন, জেলা থেকে তাকেই সুপারিশ করে কেন্দ্রে মনোনয়ন বোর্ডে পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান বাংলানিউজকে বলেন, তৃতীয় ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী নির্ধারণে মনোনয়ন বোর্ডের সভা বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) ৪টায় হওয়ার কথা। সিলেট থেকে ৩টি উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নে ৪৩ জন নৌকার প্রার্থী হতে আবেদন করেছেন। তৃণমূলে কে কত ভোট পেয়েছেন সে হিসাব এবং এগিয়ে থাকা ১৬ জনসহ বাকিদের আবেদন ও কাউন্সিলরদের ভোটের হিসাব মনোনয়ন বোর্ডের কাছে পাঠিয়েছি। তবে কারো বিরুদ্ধে যদি নৌকার মনোনয়ন পেতে আর্থিক লেনদেনের লিখিত অভিযোগ আসে, তবে খতিয়ে দেখে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তৃতীয় ধাপে সিলেটসহ সারা দেশের এক হাজার ৭টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ও ১০টি পৌরসভায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। গত ১৪ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, সিলেট বিভাগের ৯টি উপজেলার ৭৭টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নে; সুনামগঞ্জ সদর ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নে; মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা ও কুলাউড়া উপজেলার ২৩টিতে এবং হবিগঞ্জ সদর ও নবীগঞ্জ উপজেলার ২১টি ইউনিয়নে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে।

সিলেট জেলায় ১৬টি ইউনিয়ন, এরমধ্যে দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় ৫টির মধ্যে—সিলাম, লালাবাজার, জালালপুর, মোগলাবাজার ও দাউদপুর ইউনিয়ন। জৈন্তাপুর উপজেলার ৫টি হলো—জৈন্তাপুর সদর ইউনিয়ন, চারিকাটা, দরবস্ত, ফতেপুর ও চিকনাগুল ইউনিয়ন। গোয়াইনঘাট উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে—রুস্তুমপুর, লেংগুড়া, ফতেহপুর, নন্দিরগাঁও, তোয়াকুল, ডুবারি।

তফসিল অনুযায়ী এসব ইউনিয়নে মনোনয়ন দাখিল হবে ২ নভেম্বর। বাছাই ৪ নভেম্বর। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার ১১ নভেম্বর। ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে ২৮ নভেম্বর।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২১
এনইউ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।