ঢাকা, শনিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নির্বাচন

মোহনগঞ্জ থেকে মাহবুব আলম

প্রচারণায় আ.লীগ-‌‘বিদ্রোহী’, নিশ্চুপ বিএনপি

মাহবুব আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৫
প্রচারণায় আ.লীগ-‌‘বিদ্রোহী’, নিশ্চুপ বিএনপি ছবি : শাকিল/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মোহনগঞ্জ (নেত্রকানো) পৌর এলাকা ঘুরে: মদন থেকে বিস্তীর্ণ হাওরের ধুলোমাখা পথে মোটরসাইকেলে করে নেত্রকোনার পূর্বাঞ্চলের পৌর শহর মোহনগঞ্জে আসতে আসতে ঘড়িতে বিকেল পৌনে চারটা বেজে গেল।
 
এরই মধ্যে ছোট্ট এই শহরটির অলি-গলি, রেলস্টেশনের চায়ের দোকান কিংবা বাড়ির আঙিনায় শুক্রবারের (১৯ ডিসেম্বর) পৌষি বিকেলের মিষ্টি রোদ বসে গল্প করছেন স্থানীয় নর-নারীরা।

ধুলোবালিতে খেলায় মত্ত শিশু-কিশোররা।
 
শহরের টেংগাপাড়া মোড়, যে স্থানটি হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে মদন ও খালিয়াজুড়িতে যাওয়ার জনপ্রিয় যান ‌‘মোটরসাইকেল’ স্ট্যান্ড হিসেবে পরিচিত। পাশে উপজেলা বিএনপির কার্যালয়, তবে সেটি প্রায় বেশিরভাগ সময়ই তালাবদ্ধই থাকে।
 
একটু এগিয়ে স্টেশন রোডের রাস্তার মুখে কথা হয় স্থানীয় এক নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মিজানুর রহমান মিজানের সঙ্গে, যার পেশা ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালানো।
 
ভোটে প্রার্থীদের প্রচারণা কেমন দেখছেন? বলতেই শুরু করে দিলেন, ‘প্রচারণা আছে, তবে জোশ নাই আগের মতো। মানে একলা একলাই প্রচারণা। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় ভোটারদের মধ্যে উৎসাহও কম। খালি কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেবেন তারা’।
 
‌‘সবারই ধারণা, মেয়র পদে নৌকা-ধানের শীষ- দুইটা থেকে একটা তো জয়ী হইবোই। তবে বিভিন্ন ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে জমজমাট ভোটাভুটি চলছে’।
 
তার সঙ্গে কথা বলতে দেখে মূল সড়ক থেকে ফুটপাতে এগিয়ে এলেন পথচারী রেজাউল করিম, ইমতিয়াজ কবির রনি ও সরওয়ার আলম।
 
মোটামুটি একটা জটলাই হয়ে গেল, গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করলেন তারা।
 
মিজানকে থামিয়ে রেজাউল করিম ও সরওয়ার আলম বলেন, ‘প্রচারণা ভালোই, তবে শুধু আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থীকে প্রচারণা করতে দেখা যায়। বিএনপির প্রার্থীকে প্রচারণা করতে দেখছি না। তবে বিএনপির অনেক সাপোর্ট আছে, তারা প্রকাশ করছে না’।
 
স্থানীয় ধান ব্যবসায়ী রেজাউল আর সরওয়ারের সঙ্গে যোগ করে রনি বলেন, ‘আমরা প্রার্থীদের কাছে কোনো টাকা-পয়সা কিংবা দান-খয়রাত চাই না। পৌরসভার যেসব সেবা আছে, সেগুলো নিশ্চিতভাবে পেতে চাই। সেটা ধানের শীষই মেয়র হোক, আর নৌকাই হোক’।
 
তাদের সঙ্গে কথা শেষ করে একটু এগিয়ে লেভেল ক্রসিংয়ে কথা হয় ডালপুরি-বেগুনি বিক্রেতা আবদুল কুদ্দুসের সঙ্গে।
 
‌‘আমরা নির্বাচন নেয়া কি করতাম, অতো খবর-টবর রাহি না, রাজনীতি করি না হারা বছর, পেটনীতি কইরাই সময় যায় না’- ভ্যানগাড়িতে রাখা উত্তপ্ত কড়াইয়ে বেগুনি মাখিয়ে ছাড়তে ছাড়তে বলছিলেন ৩ নম্বর ওয়ার্ডের এই ভোটার।
 
তিনি বলেন, ‘সব প্রার্থীরারে মানষের কাছে যাইতে দেহি না। নৌকা আর খেজুরগাছের বেডারেই (প্রার্থী) আইতে দেখতাছি’।
 
নির্বাচনে বেচা-কেনা কেমন? এ কথা শুনেই চেচিয়ে উঠলেন তার পাশে থাকা সোলায়মান মিয়া।
 
‌বললেল, ‘নির্বাচন ড্যাম ভাই। বেহেই জাইন্যা গেছে, কারা নির্বাচনে পাস করবো। আর নৌকা-ধান হওয়ায় মানষের মধ্যে আলোচনা অতো নাই’।
 
সূত্র জানায়,  কংশ নদবিধৌত পাললিক উর্বর ভূমি ভাটি অঞ্চলের সিংহদ্বার তৎকালীন নেত্রকোনা মহকুমার মোহনগঞ্জ থানার ১৫টি মৌজা নিয়ে ১৯৭৫ সালে বর্তমান ‘মোহনগঞ্জ পৌরসভা’ গঠিত হয়। তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকারের খাদ্যমন্ত্রী আবদুল মোমেনের এই সংসদীয় আসনে বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। সর্বশেষ ‘খ’ শ্রেণীর এ পৌরসভার মেয়র ছিলেন মাহবুবুন নবী শেখ।
 
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোহনগঞ্জ আওয়ামী লীগে মোমেন পত্নী বর্তমান সংসদ সদস্য রেবেকা মোমেনের বেশ প্রভাব রয়েছে। এখানে ক্ষমতাসীন দলের দু’টি পক্ষ ‘ছিল’। একটি পক্ষে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট লতিফুর রহমান রতন আর আরেক পক্ষে আছেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মামা শহীদ ইকবাল।
 
তারা দু’জনেই এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে নৌকা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয় এমপি রেবেকা মোমেনের হস্তক্ষেপে তাদের মধ্যে বোঝাপড়া হয়।
 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘এমপি সাহেবা দুইজনের মধ্যে সমঝোতা করে দিয়েছেন। সে অনুযায়ী দল থেকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করবেন শহীদ ইকবাল আর পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে অংশ নিচ্ছেন রতন’।
 
তবে ওপরে ওপরে তারা এক হলেও তাদের কর্মী-সমর্থকরা বিষয়টি কীভাবে নিচ্ছেন- তা নিয়ে পৌর এলাকাজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
 
শহীদ ইকবাল ও লতিফুর রহমান রতন আগেও পৌর মেয়র ছিলেন। আর জহিরুল ইসলাম নামে যে স্বতন্ত্র প্রার্থী মেয়র পদে লড়ছেন, তিনি পৌর যুবলীগের আহ্বায়ক। স্থানীয় হওয়ায় তারও পারিবারিক ও রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে।
 
তবে বিএনপিরও এলাকায় দৃঢ় অবস্থান রয়েছে। মামলা-হামলা কিংবা লাঞ্ছিত হওয়ার ভয়ে মুখ খুলছেন না দলটির নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের ভোট বাক্সে ভাগ হয়ে পড়লেও বিএনপির ভোটকে ‘ফিক্সড’ হিসেবেই দেখছেন স্থানীয় সচেতন ভোটাররা।
 
মোহনগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের এক শিক্ষক বলেন, ‘বিএনপির যিনি প্রার্থী এলাকায় তার ইমেজ ভালো। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের নির্বাচনী এলাকা হওয়ায় তারও একটা প্রভাব পড়বে নির্বাচনে। সুতরাং নিবার্চন সুষ্ঠু হলে বিএনপিই এগিয়ে থাকবে’।
 
‘যদিও সেভাবে ধানের শীষের কোনো প্রচারণা চোখে পড়ে না। পোস্টার মাইকিংও নেই’- শহরের সৈয়দ মোড়ে চায়ের দোকানের সামনে দাড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন এই প্রভাষক।
 
পাশের চায়ের দোকানে বসে টেলিভিশনে বাংলা সিনেমা দেখছিলেন ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইন্নছ আলী। কান পেতে মনোযোগী শ্রোতা হয়ে শুনছিলেন তিনি।
 
এলাকার এ প্রবীণ বলেন, ‘যে যেভাবেই বলুক, নির্বাচনে নৌকাই এগিয়ে থাকবে। কারণ, এখানে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী লোকজন ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকার মান-সম্মান রাখবেনই’।  
 
৬.৯৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ পৌর এলাকার জনসংখ্যা ৪১ হাজার ৪৬০ জন। অধিকাংশই কৃষিপ্রধান ভূমিতে বিস্তৃত এ এলাকার সুপ্রাচীন বাণিজ্যিক কেন্দ্র মোহনগঞ্জের মেয়র পদে এবার তিন প্রার্থী লড়ছেন। তারা হলেন, নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী লতিফুর রহমান রতন, ধানের শীষে বিএনপির প্রার্থী মাহবুবুন নবী শেখ এবং নারকেল গাছ প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী জহিরুল ইসলাম জহির।

১৮ হাজারের ১৮১ জন ভোটারের এ পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডে এবার সাধারণ কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করছেন ২৯ জন প্রার্থী। আর সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ১২ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

নতুন মেয়রে  কাছে কেমন পৌরসভা চান? এমন প্রশ্নের উত্তরে মৃদু হেসে শহরের পাটপট্টির ব্যবসায়ী রূপক মিয়া বলেন, ‘পূর্বাঞ্চল রেলের শেষ স্টেশন মোহনগঞ্জ। সমগ্র ভাটি অঞ্চলের হাওর, বিল ও নদী থেকে আহরিত সুস্বাদু মাছ এখান থেকেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে রফতানি হয়। তাই একটু সুপরিকল্পিতভাবে পৌর শহরকে গড়ে তুলতে হবে’।
এছাড়া ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে উত্তরোত্তর বাড়তে থাকা সমস্যা বিশেষ করে পানি, বিদ্যুৎ ও পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করা জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।
 
বাংলাদেশ সময়: ১০৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৫
এমএ/এএসআর

** ‘খালি কী ভুট দিলেই অইবো, প্রার্থীরারেও দেহন লাগবো’
** মগড়ার এপার-ওপার দ্বন্দ্বে ‌‘বঞ্চিত’ পৌরবাসী
** ‘নির্বাচনে চা বেচা তো বাড়ছে না’
** ভেদাভেদ ভুলে সমান তালে নৌকা-ধানের শীষ
** ত্রিমুখী লড়াইয়ে সরগরম ভোটের মাঠ
** আ’লীগ-বিএনপি নয়, লড়াই ‘ইছা-পচার’
** ‘হারা বছর হবর নাই, এবার বুইজ্জা হুইন্না ভুট দিয়াম’
**  ডিজিটাল নির্বাচনী প্রচারণায় প্রার্থীরা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।