মিরকাদিম পৌর এলাকা (মুন্সীগঞ্জ) ঘুরে: মিরকাদিমের রিকাবি বাজারের একটি সেলুনে শেভ করতে আসেন মফিজুর রহমান ইনু (৫৫)। তখন ওষ্ঠের ওপরের অংশে ক্ষুর দিয়ে চলছিল তার ‘ক্লিন সেভিং’।
‘কী বলার আছে আমার সঙ্গে বলেন কথা’- মুখ ধুয়ে খানিক লোশন তালুতে নিয়ে ঘসতে ঘসতে মফিজুর রহমান ইনুর উচ্চারণ। এর মধ্যে দোকান অভিমুখে বেঞ্চে বসে শুরু হলো কথোপকথন। তার আগ্রহের কথা বিবেচনায় রেখে প্রশ্ন করতে হলো, তবে একটু জটিলভাবে। প্রশ্নটি ছিল- কে জিতবে মেয়র পদে এবার? মফিজুর ইনু হেসে বললেন, আর কে জিতবে; যার জেতার কথা তিনিই জিতবেন!
প্রশ্নটা করার সময় যতটা জটিল ভাবা হয়েছিল, উত্তরে তিনি তো সেটিকেও ছাড়িয়ে গেলেন। অসহায়ের মতো ফের প্রশ্ন, কার জেতার কথা তবে? হো-হো করে আশপাশে হাসির রোল পড়ে গেছে ততক্ষণে। পাশে থাকা সেলুনের মালিক কৃষ্ণ চন্দ্র শীল বললেন, ভাই যা বলছে সত্যই। এলাকায় সংসদ সদস্যদের (এমপি) হাত দিয়ে যত না উন্নয়ন হয়েছে, তার চেয়ে বেশি উন্নয়ন মেয়রের হাতে হয়েছে।
রাস্তার উপস্থিত ৩নং ওয়ার্ডের মহসীন ততক্ষণে হাত তালির প্রচলণ শুরু করে দিয়েছেন। তার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে শ্রোতা বনেছেন বাজারে যাতায়াতে পথের সাধারণ মানুষগুলো। যাদের কেউ ভোটার আবার কেউ নন। পৌষের পঞ্চম দিনেই শীত জেঁকেছে। সবার গায়ে তাই ভারী পোশাক। কৃষ্ণ চন্দ্রের কথায় সমর্থন দিলেন শ্রোতারাও। যেন বক্তা-শ্রোতা সবাই-ই বিষয়টি বোঝেন। এর মধ্যে নাপিত পলাশ, যিনি ৪নং ওয়ার্ডের ভোটার ফট করে তার কণ্ঠে ভেসে এলো, ভোট সুষ্ঠু হবে। আমরা সাধারণ মানুষ দলবেঁধে যাবো ভোট দিতে।
‘কী ভাই আপনারাও কন, যাবেন না ভোট দিবার’ হইহই করে মানুষ তখন বলতে লাগলেন ‘হ্যাঁ-জ্বি-অবশ্যই’। পরিস্থিতি এমন যেন মেতে গেছে পুরো বাজারের একাংশ!
উৎসুক লোকটি অনেক এতোক্ষণ চুপ করে ছিলেন, আর না। ‘এই থাম রে ভাই তোরা’- এটি বলে অন্যদের একটু শান্ত হতে বললেন। এরপর নিজেই শুরু করলেন বয়ান। বললেন, আমি বিএনপি করি। মিরকাদিম তথা পুরো মুন্সীগঞ্জ বিএনপির ঘাঁটি, কিন্তু এবার ভোটে তাদের ভাটা। এ কথা নিশ্চিত। আর তার চেয়েও বড় কথা মিরকাদিমে দল নয় ব্যক্তি আসল। বর্তমান মেয়রের (শহিদুল ইসলাম শাহীন) আমলে অনেক কাজ হয়েছে। আশা রাখি আল্লাহর রহমতে তিনি নির্বাচিত হয়ে এলে আরও উন্নয়ন সাধিত হবে।
এরপর ইনু তার নিজের পরিচয় দিলেন। ব্যক্তিটি পরিচয় দিয়েও অবাক করে বানিয়ে দিলেন আরকি। মফিজুর রহমান ইনু মিরকাদিম পৌরসভা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক, মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপির কার্যকরী পরিষদের সদস্য এছাড়া জেলা যুবদলের ৩নং সাধারণ সম্পাদক।
এ রকম খাস বিএনপির একজন নেতা প্রকাশ্যে বাজারে বসে নিজের দল সম্পর্কে একটিও ইতিবাচক কিছু বললেন না! এর জবাবও আছে তার কাছে। যুক্ত করলেন, সত্য কথা বলতে তো দোষ নেই।
মানুষ ভোট দিতে চায় জানিয়ে ৪নং ওয়ার্ডের ভোটার জীবন সরকার বলেন, আমি দীর্ঘ ১০ বছর সিঙ্গাপুরে ছিলাম। এখন দেশে এসেছি। নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ আছে এবার। আমি ভোটাধিকার প্রয়োগ ঘটাতে চাই। একই ওয়ার্ডের ভোটার শিক্ষার্থী তুষার বাংলানিউজকে বলেন, ভোট তো নতুন জিনিস। কারণ এটি সব সময় আসে না। তাই আমি আগ্রহী অনেক। বন্ধুরা সবাই মিলে ভোট দিতে যাবো।
২নং ওয়ার্ডের সুমন দেওয়ান নামে এক কর্মজীবী যুবক বাংলানিউজকে বলেন, গতবারও মিরকাদিমে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে। এবারও যেন হয়।
এদিকে, অনেক খুঁজে একজন নারী ভোটারকে পাওয়া গেলো। বাজার করতে এসেছিলেন। কাছে গিয়ে কথা বলতেই জানা গেলো নাম মীনা। জিজ্ঞেস করা হয়নি, বয়স বোধহয় ৩৮/৪০ হবে। কেমন দেখছেন ভোটের হালহকিকত। পরিপ্রেক্ষিতে মীনা বলেন, এবার দলীয়ভাবে মেয়র নির্বাচনের সুযোগ পেয়ে ভালোই হয়েছে। কারণ যিনিই মেয়র হবেন, পৌর ভবন এবং জনগণ ছাড়াও দলেও তার একটা জবাবদিহি থাকবে। এতে কাজের সংখ্যা বাড়বে।
বিষয়টিকে ইতিচাক হিসেবে মনে করছেন এই নারী ভোটার। তার আগে ফার্সেমির দোকানে আরেক নারী ভোটার রেশমা বাংলানিউজকে বলেছিলেন, মিরকাদিমে মিছিল-পথসভা ও প্রচারণায় লোকজন এক পক্ষে বেশি থাকলেও, এক পক্ষে ভোট হবে না। এ জন্য একটাই চাওয়া- মানুষ যেন উৎসব করেই নিজ ভোটটা দিতে যেতে পারেন।
এদিকে, সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, শহিদুল ইসলাম শাহীন অর্থ খরচ করছেন বেশি। কর্মীদের দিন হিসেবে তিনি বেশ ভালো অংকের টাকা দিচ্ছেন, তার অনেক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে এটি জানা যায়। আর অন্য প্রার্থীরা তেমন/তার মতো খরচ করছেন না, কিন্তু ভোট যুদ্ধে আছেন।
মিরকাদিম পৌরসভায় নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফয়সাল কাদের বাংলানিউজকে বলেন, আগের দু’টি ছোট্ট ইস্যু ছাড়া নতুন করে কোনো অভিযোগ আসেনি। প্রচারণা নিয়ে আমরা সজাগ আছি- যেন সবাই সমান সুযোগ পান।
ভোটের দিন নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, ওয়ার্ড ভিত্তিতে এক প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), এক প্লাটুন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়ন (র্যাব), একজন ছাড়াও অতিরিক্ত চারজন নির্বাহী ম্যাজেস্ট্রেট (হাকিম), একজন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের মোবাইল টিম, স্ট্রাইকিং ফোর্স সম্পূর্ণ পৌর এলাকার দায়িত্বে থাকবে।
মিরকাদিমের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাচন অফিসার (টঙ্গীবাড়ি) রেজাউল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে অতিরিক্ত সতর্ক ব্যবস্থা জারি এবং নির্বাচনের দিন (৩০ ডিসেম্বর) এলাকায় বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েনের জন্য কয়েক প্রার্থী বলেছেন। এটি বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়েছে। এছাড়া সুষ্ঠুভাবেই এখন পর্যন্ত ক্যাম্পেইন চলছে।
মিরকাদিমে ম্যাজিস্ট্রেট (হাকিম) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আসিফ আনাম সিদ্দিক। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, দু’টি অভিযোগ এসেছিল দুই প্রার্থীর পক্ষ থেকে। কিন্তু তদন্ত করে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি।
তিনি জানান, মেয়র-কাউন্সিলর প্রার্থীদের আচরণবিধি সুষ্ঠুভাবে প্রতিপালনে ভ্রাম্যমাণ আদালত সর্বদাই এখানে তৎপর।
পৌরসভা অধ্যাদেশ ১৯৭৭ অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের শতকরা ৭৫ ভাগের বেশি অকৃষি পেশায় নিয়োজিত থাকায় এবং প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যার ঘনত্ব দুই হাজারের অধিক ও সর্বমোট জনসংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি হওয়াতে রিকাবি বাজার ইউনিয়ন পরিষদকে মিরকাদিম পৌরসভা করা হয়। রাকাবির ১৪টি মৌজা নিয়ে ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি এই পৌরসভার যাত্রা। ২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মিরকাদিমকে ‘গ’ থেকে ‘খ’ শ্রেণীর পৌরসভা ঘোষণা করা হয়। আর ২০১৩ সালের ১০ মার্চ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এটিকে ‘ক’ বা প্রথম শ্রেণীর পৌরসভা করে।
এখানে মেয়র পদে লড়ছেন ছয়জন। সাধারণ কাউন্সিলর হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় (৯ ওয়ার্ডে) ৩১ জন আর সংরক্ষিত নারী (৩ ওয়ার্ডে) প্রার্থী ১০ জন।
মেয়র প্রার্থীরা হলেন, শহিদুল ইসলাম শাহীন (নৌকা), মো. সামছুর রহমান (ধানের শীষ), মনছুর আহামেদ কালাম (মোবাইল ফোন), মোহাম্মদ হোসেন রেনু (বাই সাইকেল), আ. গফুর মিয়া (হাতপাখা) এবং মো. জামান হোসেন (জগ)।
বাংলাদেশ সময়: ২৩১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৫
আইএ/
** লক্ষ্য-স্বপ্ন ‘এক’, দৃষ্টি ‘ছয়’
** ভোটের আগে ভাই ভাই, ভোটের পরে খবর নাই!
** ‘মনোনয়ন’ ও ‘চেতনার’ আ’লীগ এবং ‘কোণঠাসা’ বিএনপির লড়াই
** মেয়র ঢাকার, না এলাকার তা ‘ফ্যাক্টর’
** ‘পৌর ভবনে সুখ-দুখের আলাপকারী চাই’
** মেগাসিটি হবে মুন্সীগঞ্জ!
** ‘সবার আগে দোকান থেইকা টিভি সরাইসি’