শেরপুর সদর পৌরসভা থেকে ফিরে: ষাটোর্ধ্ব তরুণ সাহা। চুল-দাঁড়িতে পাক ধরেছে।
অরুণের এ দোকান অনেকটাই ফাঁকা। কিন্তু পাশের খোরশেদের চায়ের দোকানের গমগমে অবস্থা। সেখানে ভেতর আর সামনে বেঞ্চ পেতে স্থানীয় ব্যবসায়ী আরিফুর রহমানসহ বিভিন্ন বয়সী জনা দশেক ভোটার জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন। ভোটের আলাপ-আলোচনা করে চায়ের কাপেও ঝড় তুলছিলেন।
‘সবখানেই তো অহন ভোটের আলাপ। নির্বাচন তো জমছেও ভালো। নৌকা আর ধানের শীষের ফাইট হইবো’, বলছিলেন ২ নং ওয়ার্ডের দুর্গানারায়ণপুরের বাসিন্দা আরিফ।
এতোক্ষণ নীরব থাকা চায়ের দোকানদার খোরশেদ মিয়া হাঁক দিলেন, ‘নৌকা, ধান বুঝি না, যোগ্য প্রার্থীরেই সিল মারমু। ’ খোরশেদের সঙ্গে ‘হ হ’ করে কণ্ঠ মেলাতে দেখা গেলো আড্ডায় শামিল হওয়া প্রায় সবাইকেই।
জেলা পরিষদ ডাক বাংলোর সামনেই রোদের তাপে গা গরম করছিলেন শামীম ও শিপন। তারা দু’জনেই ৬ নং ওয়ার্ডের ভোটার। বাড়ি কাচারিপাড়া এলাকায়। ভোটের হিসাব-নিকাশ কষতে দেখা গেলো তাদেরকেও। মেয়র পদে দু’প্রার্থীর ব্যবচ্ছেদ করছেন তারা।
শামীম যখন বলে ফেললেন, ‘নৌকা মার্কায় ভোট টানবো বেশি। ’ তখন শিপনের কণ্ঠে উচ্চারণ, ‘বিএনপি’র প্রার্থীই তো খারাপ না। ভোটাভুটিত তারা ফালাইয়া দিবার পাইবা না। ৩০ ডিসেম্বর দেহ না কী অয়। ’
১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শেরপুর সদর পৌরসভা। তখন এটি ছিল ‘খ’ শ্রেণির। ১৯৯৩ সালে এ পৌরসভা প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত হয়। ৯টি ওয়ার্ড আর ৩৪টি ভোটকেন্দ্র। মোট ভোটার ৬৪ হাজার ২৯১ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার বেশি। ৩১ হাজার ৪৩৪ জন পুরুষ ভোটারের বিপরীতে নারী ভোটার ৩২ হাজার ৮৫৭ জন।
এগিয়ে আসা এ নির্বাচনে মেয়র পদে ভোটে দাঁড়িয়েছেন তিন প্রার্থী। তারা হলেন- আওয়ামী লীগের গোলাম কিবরিয়া লিটন (নৌকা), বিএনপি’র আব্দুর রাজ্জাক আশীষ (ধানের শীষ) ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) মাহবুবুর রহমান।
তবে ৩০ ডিসেম্বর এখানে নৌকা ও ধানের শীষের মধ্যেই ভোটযুদ্ধ হতে যাচ্ছে বলে অভিমত ভোটারদের।
আর সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৪৯ জন ও সংরক্ষিত মহিলা প্রার্থী হিসেবে ১৮ জন ভোটের মাঠ গরম করে রেখেছেন।
মঙ্গলবার (২২ ডিসেম্বর) সকালে সদরের মাজাহারুল সরকারের ফুটপাতের শীতবস্ত্রের দোকানে ভোট নিয়ে বাহাস চলছিল। এ বাহাসে উঠে আসে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী হিসেবে বর্তমান মেয়র হুমায়ুন কবির রুমান মনোনয়ন না হওয়ায় ভোটের তাপ-উত্তাপ ছড়িয়ে না পড়ার বিষয়টি।
১ নং ওয়ার্ডের রঘুনাথপুর বাজার এলাকার এক বাসিন্দা ইলিয়াছ বললেন, ‘বর্তমান মেয়রকে প্রার্থী করলে আওয়ামী লীগেরই ভালো হইতো। অহনকার প্রার্থী লিটনও মন্দ না। বিএনপি’র প্রার্থীও দোয়া চাইছে। অহন কোন প্রার্থীরে ভোট মারমু এই লইয়া দোটানার ভিতর পড়ছি। ’
মাজাহারুল সরকার বিক্রেতাদের কাছে কাপড় বিক্রি করছিলেন। আর নিবিষ্ট মনে টাকা গুণছিলেন। এবার বুঝি আর চুপ থাকতে পারলেন না। ‘ভোট লইয়া এতো ভাবার কী আছে। যোগ্য প্রার্থীরেই ভোট দিমু। যারে ডাকলেই কাছে পামু। বিপদে-আপদে আইবো, এমন প্রার্থীরেই তো ভোটটা দিতে অইবো। ’ একদমে বললেন মাজাহার।
একটু এগুতেই দেখা গেলো স্থানীয় অনুরাধা হোটেলের কর্মচারী রতন বিশ্বাস আগুনের চুলোয় উত্তপ্ত কড়াইয়ে রুটি ভাজছিলেন। কড়াইয়ের মতোও এখানে ভোটের আলাপ নিয়ে বেশ উত্তপ্ত পরিস্থিতি। ভোট নিয়ে চলছে চরম বাকযুদ্ধ। রতন বিশ্বাস নিজেও সামিল হলেন।
বললেন, ‘ফ্যামিলি লইয়া নৌকা মার্কায় ভোট দিবার যামু। ধানের শীষে ভোট দিলে তো উন্নয়ন করতে পারবো না। তহন আমার ভোটটা কামে আইবো না। ’ একজন তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়ে খাবার টেবিলে রেখেই দাঁড়িয়ে গেলেন। ‘সুষ্ঠু ভোট হইলে দেখবা, আমগর প্রার্থীরে ঠেহাইবো কে?’
তর্কযুদ্ধে আড্ডার মতো মোড়ল মনে হলো পাজামা-পাঞ্জাবি পড়া এক বয়োবৃদ্ধকে। ‘আরে মিয়া থাম তোমরা। দলকানা আলাপ ছাড়। হার-জিতের কতা কওয়ার সময় হয় নাই অহনও। কারোর চেয়ে কেউ কম না। যেই জিতবো ব্যবধান তেমন অইবো না। অপেক্ষা করো, যোগ্য প্রার্থীরে ভোট দেও। ’ তখন শান্ত হলো অনুরাধা হোটেলের পরিবেশ।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৫
জেডএস
** ‘আপনারা কোন পার্টিতন আইছেন’
** ‘দিনে ৪/৫ কাপ চা আর পান খিলাইতাছি’
** মেয়র নির্বাচনে এখানে কারচুপির রেকর্ড নেই
** বিদ্রোহী নিয়ে আ’লীগ আর ঘরের শত্রুর শঙ্কায় বিএনপি
** পৌরসভা শুধু নামেই!
** ‘ভোটের কতা কমু না’
** নির্বাচনী চা!
** ‘আসল খেলা ইলেকশনের আগের রাইতে’
** সুন্দর পরিচ্ছন্ন শহর গড়ার অঙ্গীকার দুই মেয়রপ্রার্থীর
** নৌকা ঠেকাতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে বিএনপি!