ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

রোড টু কান

জনি হক স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট... কান (ফ্রান্স) থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৩ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৫
রোড টু কান ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

১০ মে। ভোর চারটা।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চেক ইন করার একটু পরে চোখে পড়লো বাচ্চা কোলে একজন হাসিমুখে এগিয়ে আসছেন। পেছনে একজন ভদ্রমহিলা। বোঝা গেলো তারা দম্পতি। ধারণা মিথ্যে হয়নি। চলচ্চিত্র পরিচালক স্বপন আহমেদ, তার স্ত্রী মালিহা এবং তাদের একমাত্র কন্যাসন্তান শ্যাননও কান উৎসবে যাচ্ছেন। শ্যাননের বয়স মাত্র ১ বছর চার মাস।

বোর্ডিং পাস নিয়ে ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে উড়োজাহাজের জন্য অপেক্ষা। ওড়ার সময় ৬টা ১০। ততোক্ষণে ঘড়ির কাঁটা পেরিয়েছে সাড়ে পাঁচটার ঘর। ফ্লাইট যে দেরি হচ্ছে তা পুরোপুরি নিশ্চিত। হলোও তা-ই। ছয়টার কাটা ছুঁইছুঁই করতে উড়ে যাওয়ার বাহন নামলো রানওয়েতে। যাত্রীদের লাগেজ নামানো, নতুন যাত্রীদের লাগেজ ওঠানো; সব মিলিয়ে আরও ৪০ মিনিটের ধাক্কা! অপেক্ষার ঘরে প্রতীক্ষা শেষ হলো।

বিমানকর্মীদের অভ্যর্থনার জবাব দিয়ে নিজের আসনের (১৫ কে নম্বর) সামনে যেতেই চোখে পড়লো এক তরুণ পাশে ঘুমিয়ে আছে। জানালার পাশে আমার আসন, তাই তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতেই হলো ঢোকার জন্য। তিনি হাসিমুখেই মেনে নিলেন তা। ছেলেটার নাম কেনেডি। অনুমতি নিয়ে তার সঙ্গে সেলফিও তোলা হলো। আসনের সামনে ছোট পর্দায় ছবি দেখা ও গান শোনার সুযোগ রয়েছে। সময় কাটানোর জন্য সেসবে মন দিতেই হলো। বাইরের তাপমাত্রা তখন ৫৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস! ছোট্ট টিভির মতো যন্ত্র জানিয়ে দিলো এসব তথ্য। ভেতরে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে বসে জানালা দিয়ে মাঝে মধ্যে বাইরের আকাশ দেখে মুগ্ধ হলাম। মাটি থেকে তখন ৪০ হাজার ফুটেরও ওপরে উড়ছি! সাদা ভেলাগুলোকে মনে হলো ঝুঁলিয়ে রাখা হয়েছে। কখনও মনে হলো, ভেলার পাহাড় থোক থোক করে সাজানো! তুরস্কের আকাশসীমার ওপর দিয়ে আসার সময় আরও চোখে পড়লো নদী। দূরে বিশাল সমুদ্রে একটা মাঝারি আকারে নৌকা দেখে মনে পড়ে গেলো ‘লাইফ অব পাই’ ছবির কথা।

ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক হাভালিমানি বিমানবন্দরে নেমে উঠতে হলো বাসে। কারণ রানওয়ে একটু দূরে। তবে বিমানবন্দরের ভেতরে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। এমনিতেই দেরি হওয়ায় ট্রানজিটের সময় খরচ হয়ে গেছে ঢাকাতেই। তাছাড়া বোর্ডিং পাস আছে না! কিন্তু নিরাপত্তার আনুষ্ঠানিকতায় অবাক হতে হলো। বাংলানিউজের দেওয়া ল্যাপটপ বের করে আলাদা ট্রলিতে দিতে হলো। ব্যাগ তো আছেই। কিন্তু নিরাপত্তা রক্ষীরা বেল্ট খুলতে বললেন! এটাই নিয়ম। তাই কিছু করার নেই। বেল্টও অনেকক্ষণ পরে থাকায় একঘেয়েমি লাগছিলো! মনে হচ্ছিলো, একটু খোলার উপলক্ষ্য পেয়ে ভালোই হলো! বিমানবন্দরের ভেতরে শানেল, গুডি, ডিওরের মতো বিখ্যাত সব প্রতিষ্ঠানের দোকান। সেসব দেখতে দেখতে চেক ইন করার জায়গা চলে এলো। এরপর বোর্ডিং পাস আর পাসপোর্ট দেখিয়ে উঠতে হলো বাসে। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উড়োজাহাজের ওপরে উঠে বিমানকমীদের অভ্যথর্না। এবার পাশাপাশি তিনটি আসন। কাছাকাছি যেতেই এক বিদেশিনী বললেন, ‘২৯ কে?’ মনে মনে বললাম, বাহ! বিদেশি হলো বাংলা জানেন তিনি। উত্তরে বললাম, জ্বি আমি। ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে বললেন, ‘সরি, আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড!’ বুঝলাম আমার আসন নম্বর ২৯কে কি-না তা জানতে চেয়েছেন। বিমান উড়লো। সামনের ছোট টিভিতে উল্লেখ করা আছে গন্তব্যে অর্থ্যাৎ প্যারিস যেতে তিন ঘণ্টা ৫৮ মিনিট লাগবে। মেঘের ভেলা, আল্পস পবর্ত, নদী-নালা পেরিয়ে প্যারিস বিমানবন্দরে নামলাম। তখন ঘড়ির কাঁটায় ৬টা ২৪ (বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ২৪)। স্বাভাবিকভাবেই দিনে গরম এবং রাতে শীত। তবে গরমের তাপমাত্রা কোনেভাবেই ২০ ডিগ্রির ওপরে না।

বিমানে ওড়াওড়ির পালা শেষ। এবার ইমিগ্রেশন অনুমতি দিলেই বের হওয়া যাবে। ইমিগ্রেশন অফিসার জানতে চাইলেন, ‘ডু ইউ নো ইংলিশ?’ উত্তর দিলাম, ‘ইয়েস। ’ এরপর প্রশ্ন এলো, ‘হোয়াই ইউ কেম হিয়ার?’ জানতাম এ ধরনের প্রশ্ন আসবে। স্বপন আহমেদ প্যারিসে অনেক বছর ধরে আছেন। তিনি আভাস দিয়েছিলেন, এমন কিছু জানতে চাইতে পারে। তাই উত্তর আগে থেকেই ভেবে রেখেছি- ‘ইউ নো কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল? আই উইল কাভার দিস ইভেন্ট। আই অ্যাম ইনভাইটেড দেয়ার। আই ওয়ার্ক ইন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। ইটস অ্যা লিডিং নিউজ পোর্টাল ইন বাংলাদেশ। ’ এবার তিনি উৎসবের আমন্ত্রণপত্র দেখতে চাইলেন। সেটা দেখতেই বললেন, ‘ওকে, ইউ ক্যান গো। ’

লাগেজ সংগ্রহের পর স্বপন আহমেদ জানালেন তার এক বন্ধুর গাড়ি নিয়ে বিমানবন্দরে আসার কথা। বেরিয়ে যেতেই তিনি এলেন। নাম কামাল হোসেন। শুভেচ্ছা বিনিময় হলো। গাড়ি চালাতে চালাতে তিনি জানাচ্ছিলেন, প্যারিসে এখন প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশি আছে। পরদিন (১১ মে) ভাস্কর নভেরা আহমেদের অন্তিম বিদায়ের অনুষ্ঠানে প্যারিস প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকে যাবেন। থাকবেন ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. শহীদুল ইসলাম। গাড়ি সড়ক আর টানেল পেরিয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর এগোতে দেখলাম বেশকিছু মানুষ রাস্তার একপাশে কেউ বসে আছে, কেউ দাঁড়িয়ে। এরা বিনামূল্যে খাবার পেতে অপেক্ষা করছেন। রেস্ত দু কর নামের একটি সংগঠন প্রতিদিন সকাল ও রাতে দু’বেলা খাবার দেন তাদেরকে। তারা বেশিরভাগই ইস্ট-ইউরোপিয়ান। এসব তথ্য জানিয়ে পথিমধ্যে লাল সিগন্যাল দেখে থামলেন কামাল। সামনে কোনো গাড়ি নেই। রাস্তাও ফাঁকা। তবুও এখানে চালকদের মধ্যে কোনো অনিয়ম নেই। আইন কড়া। নিয়ম ভাঙলেই খুঁজে এনে জরিমানা। রাস্তার এক পাশ দিয়ে সাইকেল আরোহীদের জন্য পৃথক লেন। মোড়ে মোড়ে রেস্তোরাঁর বাইরে চেয়ারে বসে খেতে ব্যস্ত ফরাসিরা। শহরজুড়ে কোনো বিলবোর্ড নেই। শুধু বিভিন্ন সড়কের মোড়ে কাচঘেরা বিজ্ঞাপন চোখে পড়লো। চাকচিক্য পাওয়া গেলো না কোনো ভবন কিংবা দোকানপাটে। তবে আভিজাত্য আছে। বেশিরভাগ স্থাপনায় পাথরের আধিক্য।

প্যারিসের সবখানেই যেন সুগন্ধি ছড়ানো। নাকে সারাক্ষণই চকোলেটের ঘ্রাণ লাগে! কোথাও ধূলোবালি নেই। কলের পানি ফুটানো জলের চেয়েও স্বচ্ছ ও স্বাস্থ্যসম্মত। মেয়েরা পথেঘাটে সারারাত একা চলাফেরা করতে পারে। তাদের সঙ্গে কেউ টু শব্দটিও করে না। তবে বিচ্ছিন্নভাবে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। আফ্রিকানরাই এসব বেশি ঘটায়। ধরুন মেট্রো রেলে ওঠার সময় তাদের কেউ নামতে গিয়ে ব্যাগ কিংবা মোবাইল নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাবে। আবার দোকানের বাইরে প্রাঙ্গণে কিছু খেতে গিয়ে টেবিলের ওপর মোবাইল বা অন্যকিছু রেখে অন্যমনস্ক থাকলে হাওয়া হয়ে যাবে জাদুর মতো! আর একটা দিক লক্ষ্যণীয়। প্যারিস ব্যয়বহুল শহর। সবকিছুই।

ঘড়িতে তখন প্যারিস সময় অনুযায়ী সন্ধ্যা সাতটা। অথচ সূর্য ডোবেনি তখনও! গ্রীষ্মকালে এখানে এমনটাই হয়। সূয্যিমামা বিদায় নিতে নিতে বেজে যায় রাত ১১টা। তবে ফরাসিরা নৈশভোজ সেরে নেন সাতটা-আটটার মধ্যে। দেরিতে সূর্য অস্ত যায় বলে বেলা করে রোদ উঠবে তা কিন্তু নয়। সূরযোদয় হয় ঠিক ছয়টার মধ্যে। ফরাসিরা সুপ্রভাতকে বলে ‘বু-জু’। সান্ধ্যকালীন শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভাষা হলো ‘বু সোয়া’। আর শুভরাত্রির জন্য বলে থাকে ‘বু-নুই’।

অপিতাল মিলিতেয়া বিলমা নামে একটা পার্ক আছে প্যারিসে। এখানে শিশুদের খেলার জন্য আলাদা ব্যবস্থা দেখা গেলো। মায়েরা এক পাশে সারি বেঁধে বসে আছেন। তাদের সন্তানরা খেলছে। একটু এগোতেই সবুজ ঘাসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। একদল যুবক গিটার বাজিয়ে গাইছেন। প্রেমিক যুগলরা মনের কথা ভাগাভাগি করছেন। ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ কথাকে ফরাসিরা বলেন, ‘জ্যঁ তেম’। প্রেমিককে উদ্দেশ্য করে এক তরুণীর মুখে শোনাও গেলো কথাটা। আরেক কোণে দেখলাম মা তার সন্তানকে নিয়ে সময় কাটাচ্ছেন। সেখান থেকে বেরিয়ে একটু হাঁটতেই চোখে পড়ে একটা থিয়েটার। মঞ্চনাটকের মিলনায়তন। দেখেই বোঝা যায় অনেক পুরনো। হঠাৎ কানে ভেসে এলো গানের সুর। কয়েক কদম এগো্তেই জানা গেলো, সূর্য ডুবে গেলে মোড়ে মোড়ে তরুণ-তরুণীরা জড়ো হয়ে মনের আনন্দে গায়।

প্যারিস যেন পুরোটাই একটা ছবি। একটা ক্যানভাস। এই শহরের পরতে পরতে শৈল্পিক সব ব্যাপার-স্যাপার। আইফেল টাওয়ার, লু্ভ জাদুঘর আরও কতো কি! কানের তাড়া আছে বলে সব ঘোরা হলো না। প্যারিস থেকে ট্রেনে চড়ে নামলাম কান শহরে। চলচ্চিত্রের তীর্থস্থানে।

বাংলানিউজে কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সব খবর প্রকাশিত হচ্ছে www.rabbitholebd.com এর সৌজন্যে।

ফ্রান্স সময় : ০৪৪৯ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৫
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।