কান (ফ্রান্স) থেকে: ফেসবুক বন্ধুদের স্ট্যাটাস দেখে জানলাম, ঢাকায় অসহ্য গরম। কানে এখন বিপরীত চিত্র।
ফরাসিদের কাছে নাকি এই আবহাওয়া যুতসই। মেয়েদের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখলে সেটা ভেবে নেওয়া ভুলও হবে না। কিন্তু ক্যাফেগুলোতে ঢুকলেই দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। হিটার দিয়ে গরম করে রাখা সব! সেখানে দিব্যি সময় কাটিয়ে আবার বাইরে যাচ্ছে তরুণ-তরুণীরা। যদিও সংখ্যাটা কম। কারণ উৎসব চলে এসেছে শেষ প্রান্তে। আর মাত্র দুই দিন। তাই ছবির প্রদর্শনীর সময় ছাড়া খুব একটা ভিড় দেখা যায় না।
এদিকে উৎসবে অংশ নেওয়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদকর্মীদের জন্য মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেছেন কান শহরের মেয়র ডেভিড লিসনার্ড। আমন্ত্রণ পেয়েছে বাংলানিউজও। শুক্রবার দশম দিনে দুপুর দেড়টার আগে থেকেই সবার গন্তব্য প্যালেস ডি লা ক্যাস্টরে। এটি ঐতিহ্যবাহী লে শুকে নামের একটি জায়গায় অবস্থিত। যাওয়ার পথে হোটেল দি ভিলের কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেই হলো এর মনোরম স্থাপনার জন্য। আভিজাত্য একেই বলে। দুই মিনিট হাঁটার পর সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার পালা। সিঁড়ি শেষে পাহাড়ি পথের মতো উঁচু পথ। পাঁচ মিনিট উঁচুতে উঠতে উঠতে পাওয়া গেলো প্যালেস ডি লা ক্যাস্টেরের ফটক।
সারি বেঁধে মানুষ ভেতরে ঢুকছে। নিরাপত্তাকর্মীরা আমন্ত্রপত্র দেখছেন। একটা অংশ ছিঁড়ে রাখা হচ্ছে। ভেতরে ঢুকে বাকি অংশটা জমা নিয়ে দেওয়া হচ্ছে জলপাইয়ের তেল। ফাঁকা আসনগুলোতে একে একে বসছেন সবাই। তবে আলেকচিত্রীরা কেউই বসে নেই। তারা জটলা বেঁধে একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সেখানে আসবেন ৬৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগের বিচারকরা। তারা আসতেই আলোর ঝলকানি বের হতে থাকলো ক্যামেরা থেকে। তারা খাওয়া শুরু করতেই নিরাপত্তা কর্মীরা ছবি তোলা নিষিদ্ধ করে দিলেন।
এরপর আলোকচিত্রীরাও সারি বেঁধে খাবার সংগ্রহ করতে থাকা অতিথিদের সঙ্গে সামিল হলেন। আমন্ত্রণপত্রেই মেয়র উল্লেখ করেছেন, 'ফরাসি ঢঙে মধ্যাহ্নভোজের মাধ্যমে কানের আরেকটি দিক সম্পর্কে জানার সুযোগ হবে। উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই এটা পান না। ' সত্যি ভেতরে ঢোকার পর ওপর পুরো কান শহরকে দেখা যাচ্ছে। মেন্যুতে আছে স্থানীয় মাছ, সবজি, ডিম, মিষ্টান্ন খাবার এবং ফরাসিদের প্রিয় ওয়াইন।
খেতে খেতে সামনে বসা এক ভদ্রলোক হঠাৎ জানতে চাইলেন কোত্থেকে এসেছি। বাংলাদেশ বলার পর বললেন, 'গ্রেট!' তিনি জানালেন, বাউল গান তার ভালো লাগে। পবস দাস বাউলের পরিবেশনা দেখেছেন। ভদ্রলোকের নাম মার্ক। মুক্ত সাংবাদিক। উৎসব নিয়ে লিখছেন স্থানীয় একটি পত্রিকায়। কলকাতার এক পরিচালকের কাজের ভক্ত। কিন্তু নাম মনে করতে পারছেন না। পাশে বসা বাংলাদেশি আরেক সাংবাদিক তাকে কয়েকটা নাম বলে সহায়তা করলেন। কিন্তু ভদ্রলোক নিশ্চিত নন। তাই মোবাইল হাতে নিয়ে গুগলের শরণাপন্ন হলেন। এরপর 'পেয়েছি! পেয়েছি!' খুশি নিয়ে জানালেন, 'ঋত্বিক ঘটক!' মার্ককে বললাম, ঋত্বিক কিন্তু বাংলাদেশে জন্মেছিলেন। শুনে অবাক হওয়ার সুরে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো- 'তাই নাকি!' বাংলাদেশের 'তিতাস একটি নদীর নাম' ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন, জানানো হলো সেই তথ্যও। তিনি দেখবেন বলে ঠিক করলেন। বিদায়ের আগে মার্ক আমাদের দুই সাংবাদিকের ছবি তুলে রাখলেন।
প্যালেস ডি লা ক্যাস্টর থেকে বেরিয়ে ফেরার পথে পামবাস স্টেশনের ওপর চোখে পড়লো কুয়েন্টিন টারান্টিনো নাচছেন। ছবিটি গতবার কান উৎসবের লালগালিচায় তোলা। উৎসবের অফিসিয়াল কাজ শেষে রাতে হোটেলে ফেরার পথে একটা পায়রা কোত্থেকে উড়ে এসে সামনে একচক্কর ঘুরে আবার উড়ে গেলো। মাঝে পামবাস থামার জায়গার ঠিক উল্টোপাশে এক শিশুর ভাস্কর্যের ওপর পায়রাটা বসলো। কান শহরের আবহাওয়ার যেমন ঠিক-ঠিকানা নেই, আবার এখানে কখন কি দেখা যাবে তা-ও আশ্চর্যজনক!
বাস চলে এসেছে। উঠেই ফরাসি তিন নারীকে আলাদা মনে হলো। তিনজনই মাথায় স্কার্ফ পরেছেন। সঙ্গে লম্বা বোরকা। চোখ-মুখ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। প্যালেস দ্যু ফেস্টিভ্যাল ভবনের সামনেও আজ এমন একজনকে চোখে পড়েছে। বাসে চলতে চলতে হঠাৎ পকেটে হাত দিয়ে দুটি কাগজ পেলাম। এগুলো প্যালেস ডি লা ক্যাস্টরে ঢুকতেই দেওয়া হয়েছিলো। এটা মূলত কান শহরকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত করার জন্য ভোট দেওয়ার আবেদনপত্র। কিন্তু সচেতনভাবেই তা পূরণ না করে এড়িয়ে গেলাম। ভাঁজ করে রেখে দিলাম পকেটে। বেরিয়ে আসার সময় আবেদনপত্র হস্তান্তর করার অনুরোধ জানানো হচ্ছিলো। কিন্তু এবারও অনেকটা ইচ্ছে করেই না দেখার ভান করলাম। কারণ আমারও দেশের মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন!
(বাংলানিউজে কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সব খবর প্রকাশিত হচ্ছে www.rabbitholebd.com এর সৌজন্যে।
ফ্রান্স সময় : ০১১৭ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৫
জেএইচ
** বাংলানিউজে কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সব খবর