রাত তখন অনেকখানি গড়িয়েছে। পুরো ইনডোর স্টেডিয়াম ঝিমিয়েই পড়েছে বলা চলে।
এমনকি যারা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিলেন, তারাও গেলেন থেমে। ফিরলেন নিজের আসনে। দেশীয় চলচ্চিত্রের রাজপুত্র বলে কথা! মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামের এই মঞ্চে কি ঘটতে যাচ্ছে তাকে ঘিরে- সেটাই দেখার প্রতীক্ষা শুরু হলো দর্শকদের।
অনুষ্ঠান ছিলো গানের। চ্যানেল আই-সিটিসেল দশমবারের আয়োজন করলো মিউজিক অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান। ১৫ জুনের সন্ধ্যা তাই বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিলো দেশের সংগীত সংশ্লিষ্টদের কাছে। অনুষ্ঠানে সালমান শাহকে স্মরণ করা হলো নাচে-গানে। তারই অভিনীত ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ ছবির গান ‘বৃষ্টিরে বৃষ্টি আয় না জোরে’ মাতিয়ে দিলো দর্শকদের। সেই একই আবেদন, দর্শকপ্রিয়তা আর উন্মাদনা! পার্থক্য শুধু একটাই- সালমান শাহ-শাবনূরের জায়গায় আনিসুর রহমান মিলন ও তমা মির্জা।
পুরো আয়োজনে এমন মনে রাখার মতো ঘটনা আরও ছিলো। অনুষ্ঠানের শুরুর দিকের দৃশ্য। মঞ্চে ডাকা হলো ফেরদৌসী রহমানকে। বাংলা গানে তার অবদান যে কতো বিশাল- সংগীতপ্রেমীদের কাছে সেটা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। আজীবন সম্মাননা দেওয়া হবে তাকে। তিনি মঞ্চে এলেন। উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো হাজারো দর্শক। চললো করতালি। সামনে দাঁড়িয়ে ফেরদৌসী, তার পেছনে বিরাট পর্দায় ভেসে উঠছে কিশোরী ফেরদৌসী, তরুণী ফেরদৌসী।
আর্কাইভ থেকে খুঁজে আনা পুরনো ভিডিওচিত্র দেখানো হচ্ছে। ভয়েস ওভারে কেউ একজন বলে চলেছেন ফেরদৌসী রহমানের জীবনের গল্প, গানের গল্প। সেদিকে নির্বাক তাকিয়ে তিনি। জীবনের প্রায় পড়ন্ত সময়ে দাঁড়িয়ে তারই চোখের সামনে হাসিমুখে পুরো জীবন- কেমন লাগছিলো তার? কান্না পাচ্ছিলো কি? বলে দিলেন নিজেই, ‘এই সুন্দর সন্ধ্যাটা আমি কেঁদে নষ্ট করতে চাই না। আমার সবসময় মনে হয়, গানের জন্য আমি যতটুকু করেছি, বিনিময়ে পেয়েছি তার অনেক বেশি। ’ তার অনুরোধে মঞ্চে ডেকে নেওয়া হলো মুস্তাফা জামান আব্বাসী ও সাবিনা ইয়াসমিনকে।
আরও একটা ঘটনা না জানালেই নয়। এটাও অনুষ্ঠানের শেষের দিকের। হাততালি দিতে দিতে দর্শক তখন প্রায় ক্লান্ত। হাত আর নড়ছে না, শব্দ কমে আসছে। শোনা যাচ্ছে না প্রায়। ঠিক এমন সময় ঘোষণা করা হলো তাহসানের নাম। ক্লান্ত হাতগুলো মুহূর্তেই তেজ ফিরে পেলো যেন! এবার করতালি আর থামে না। তাহসান মঞ্চে এলেন, পুরস্কার নিলেন। তার আগে তিনি বললেন, ‘যার জন্য আমি আজ গান গাইতে পারছি, এই পুরস্কারটা তার। ’ তিনি তাহসানের মা। তাহসান দর্শকসারি থেকে মাকে নিয়ে এলেন মঞ্চে। মায়ের হাতে মাইক্রোফোন দেওয়া হলো। ঠিকমতো কথাও শেষ করতে পারলেন না তিনি। কান্নায় ধরে আসলো গলা। মঞ্চে সারাটাক্ষণ একহাতে মাকে জড়িয়ে ধরে থাকলেন তাহসান।
এমন টুকরো টুকরো দৃশ্য, গান আর নাচের ফাঁকে ফাঁকে চললো পুরস্কার প্রদান। সমালোচক বিভাগে পুরস্কার পেলেন রবীন্দ্রসংগীতে সাবিনা ইয়াসমিন (আমি সন্ধ্যাদ্বীপের শিখা), নজরুলসংগীতে খায়রুল আনাম শাকিল (বেণুকা), লোকসংগীতে কিরণ চন্দ্র রায় (কোন কালে তোর হবে দিশে, গান: জানলি না মন কোথায় সে), আধুনিক গানে সামিনা চৌধুরী (গান : অনুরোধ করে), নবাগত শিল্পী হিসেবে স্মরণ (গান : কাছে আসতে মানা), সংগীত পরিচালনায় নকীব খান (গান : তুমি পাশে বলে কি সুন্দর), সেরা গীতিকার জুলফিকার রাসেল (গান : আমার মন ভালো নেই), চলচ্চিত্রে গানের অ্যালবাম ‘ভালবাসা আজকাল’ [গান : এই প্রথম একটি মুখ, শিল্পী : কিশোর ও ন্যান্সি), অ্যালবামের প্রচ্ছদ ডিজাইনে সৈয়দ কামাল (আমার সেরা, ফেরদৌস আরা], শব্দ প্রকৌশলী হিসেবে মিশাইল কবির (ফেরা), সেরা ব্যান্ড চিরকুট (যাদুর শহর), মিউজিক ভিডিও নির্মাণে শুভব্রত সরকার (তোমাকে ছাড়া, অ্যালবাম : জানে খোদা)।
দর্শক-শ্রোতার পছন্দে পুরস্কার জিতে নিয়েছেন আধুনিক গানে তাহসান (তুই চাইলে, অ্যালবাম : নিমন্ত্রণ), সেরা ব্যান্ড জলের গান (অতল জলের গান), নবাগত শিল্পী স্মরণ (কাছে আসতে মানা, অ্যালবাম : স্মরণের জানালা), ছায়াছবির গানে চন্দন সিনহা (আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো, ছবি : পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী), ফিউশনে কৃঞ্চকলি (দালান দিলি, অ্যালবাম বনফুল)।
অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন সাবিনা ইয়াসমিন, তপন মাহমুদ, ফেরদৌস আরা, আবিদা সুলতানা, রফিকুল আলম, ফরিদা পারভীন, আকরামুল ইসলাম, আইয়ুব বাচ্চু, শাহনাজ বেলী, রিজিয়া পারভীন, মনির খান, তাহসান, সজীব, ইমরান, অভিক, নির্ঝর, ফকির শাহাবুদ্দিন, দিনাত জাহান মুন্নী, কোনাল, কনা, আরিফ, শফিক তুহিন, সুবর্ণা, স্মরণ, রন্টি দাস, শাকিলা, ঝিলিক প্রমুখ।
জনপ্রিয় গানের তালে আরও নেচেছেন ওমরসানি, শিলা, সুমন ও প্রসুন আজাদ। পুরো অনুুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন ফারজানা ব্রাউনিয়া। পরিচালনায় ছিলেন শহিদুল আলম সাচ্চু। ধারণকৃত অনুষ্ঠানটি চ্যানেল আইতে শিগগিরই প্রচার হবে।
** আজীবন সম্মাননা পেলেন ফেরদৌসী রহমান
বাংলাদেশ সময় : ০৩১৫ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৫
কেবিএন/