ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

দিশেহারা এ্যানি মুড়ি ভেজে এখন উদ্যোক্তা

কাজী আব্দুল কুদ্দুস, ডিষ্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০২৪
দিশেহারা এ্যানি মুড়ি ভেজে এখন উদ্যোক্তা মুড়ি ভাজছে এ্যানি

রাজবাড়ী: রাজবাড়ী জেলার দৌলতদিয়া যদু ফকীর পাড়ার বাসিন্দা এ্যানি বেগম। এইচএসসি পাস করার পর অর্থের অভাবে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়।

২০১৫ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় মুক্তার ফকীরের সঙ্গে। স্বামীর সংসারেও অভাব অনটন। এর মধ্যে স্বামীর হঠাৎ অসুস্থতায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে এ্যানির মাথায়। অসুস্থ স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন এ্যানি বেগম।

এভাবে বেশি দিন ঘরে বসে থাকেননি এ্যানি। কর্মের সন্ধানে ঘর থেকে বের হন। গোয়ালন্দ উপজেলা মহিলা অধিদপ্তর থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়িতে বসে কাজ করেন। পরিবারের অভাব কিছুটা নিরসন হয়। তবে সেই জায়গায় থেমে নেই তিনি। স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে ইউটিউব দেখে শেখেন মুড়ি ভাজা। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে প্রথমে একটি মেশিন, একটি ঘর ও কিছু আমানত সংগ্রহ করেন। তারপর আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, স্থানীয় এনজিও থেকে টাকা ঋণ সংগ্রহ করে মুড়ি ভাজা শুরু করেন। স্বামী এবং শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে ধীরে ধীরে শুরু করেন মুড়ি ভাজা। তারপর বাজারজাত। এভাবে চলতে থাকে এ্যানি’র সংগ্রামী জীবন। মুড়ি বাজারজাত করার পর থেকে তাকে আর পেছনের দিকে তাকাতে হয়নি।

এ্যানি আক্তার বলেন, করুনা নয়। কর্মের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে চাই। লজ্জা করে ঘরে বসে থাকলে কেউ খাওয়াতে আসবে না। তাই অভাব অনটন ও দারিদ্রতাকে দুর্বলতা না ভেবে বরং পুঁজি গুছিয়ে কাজ শুরু করেছি। প্রথমে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছি। অনেকেই বলতে শুনেছি নারীরা ঘরে থাকবে। সে কেন ঘর থেকে বের হবে। না, আমি পারিনি। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ঘরে বসে থাকতে পারিনি। তাই মানুষের কথা কান না দিয়ে নিজের আত্মকর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছি।

এ্যানি বেগম আরও বলেন, এখন আমি সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত নিজের কর্মস্থানে কাজ করি। আমার কাজের সঙ্গী স্বামী ও শাশুড়ি। পাশাপাশি আরও দুই কর্মচারী রয়েছে। মোট ৫জন কাজ করি।

নারী উদ্যোক্তা এ্যানি বলেন, এ মুড়ি স্বাস্থ্য সম্মত। মাটির চুলায় ভাজা হয়। তবে একটি মেশিন শুধু মোটরে ঘুরে। এতে চাল গরম করতে হয়। এরপর গ্রামীণ পদ্ধতিতে মাটির চুলাই লবণ মিশিয়ে মুড়ি ভাজা হয়। কোনো প্রকার কেমিক্যাল মেশানো হয় না। বাজারে চাহিদাও অনেক।

এ্যানি আরও বলেন, এখন প্রতিদিন প্রায় ৪০০ কেজি মুড়ি ভাজতে পারি। বাজারজাতও করি। বড় পরিসরে করার ইচ্ছা আছে। ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে টাকা নিতে পারলে ব্যবসা করা সম্ভব হতো। কিন্তু যেখানে চাই, সেখানে কঠিন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। সুতরাং ব্যাংক লোন নিতে পারি না। তবে আমি হতাশা নই। আমি আশাবাদী।

প্রতিবেশী আক্কাস মোল্লা বলেন, গৃহবধূ এ্যানি এখন তাদের সংসাদের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তিনি একজন সংগ্রামী নারী।

স্থানীয় বাসিন্দা জাহানারা বেগম বলেন, মুক্তারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। বিয়ের কিছু দিন পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু ওর স্ত্রী এ্যানি কারো সহযোগিতা না নিয়ে কাজ শুরু করেন। এখন মুড়ি ভাজার কারখানা দিয়ে অনেক ভালো আছেন। ওর সাহসিকতা দেখে এখন অনেকে এগিয়ে আসছে।

দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান মণ্ডল বলেন, আমি গর্বিত আমার ইউনিয়নের সাধারণ নারী-পুরুষ এখন ঘরে বসে নেই। বিভিন্ন কর্মের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছেন। তবে এক্ষেত্রে সহযোগিতা লাগলে অবশ্যই আমি করবো। গৃহবধূ এ্যানি হাতে মুড়ি ভেজে আয় করে সংসার চালাচ্ছেন এটি অনেক গর্বের বিষয়।

গোয়ালন্দ মহিলা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা সালমা বেগম বলেন, এ্যানি মহিলা অধিদপ্তরের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের পরামর্শ নিয়েছেন। তিনি এখন ছোট্ট পরিসরে একটি মুড়ি ভাজার কারখানা তৈরি করেছে। যেখানে পরিবারের সদস্যসহ ৫ জন কর্ম করছেন। এ নারী উদ্যোক্তা এ্যানি’র সামনের দিকে আরও এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা কাজ করছি। আশা করি এ্যানি’র মতো অনেকে ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে বসে না থেকে উদ্যোক্তা হবেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০২৪
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।