ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

লোকজ আচার-অনুষ্ঠানের সাতকাহন-১

সানজিদা সামরিন, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৫
লোকজ আচার-অনুষ্ঠানের সাতকাহন-১

ঢাকা: প্রতিটি দেশেরই রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি ও আচার-অনুষ্ঠান। ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস, আচার-আচরণ, জীবন প্রণালী ও দৈনন্দিন চিত্তবিনোদনের সহজাত মাধ্যম ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা স্থানভিত্তিক অনুষ্ঠানকে লোকজ আচার-অনুষ্ঠান বলা হয়।



তবে সময়ের পালাবদল ও নগরায়নের ফলে চিরাচরিত বাঙালি ঘরণায় পালিত লোকজ আচার-অনুষ্ঠানগুলো বলতে গেলে প্রাণ হারিয়ে ফেলেছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে বিলুপ্তির পথে।  

বলা হয়ে থাকে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। কারণ, এসব আচার-অনুষ্ঠানগুলো প্রধানত চন্দ্রতিথি, মাস, পেশা ও ঋতুভিত্তিক। এছাড়াও এসব আচার-অনুষ্ঠানের পেছনে রয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাস, মঙ্গল কামনা, সাধুবাদ, ব্যাধি, ক্ষয়-ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রত্যাশা। শৌখিন জাতি হিসেবে বাঙালি যেসব উৎসব হরহামেশাই পালন করতো, বিংশ শতাব্দীতে তা আজ অনেকেরই অজানা। বাংলা নববর্ষে সেসব আচার-অনুষ্ঠানগুলো একবার ঘুরে আসা যাক।

চৈত্র সংক্রান্তি
বর্ষবরণ থেকেই শুরু করা যাক। বাংলা বছরকে বরণ করতে প্রস্তুতি শুরু হয় একটু আগে থেকেই। প্রাচীনকালে অসাম্প্রদায়িক বাঙালির কাছে চৈত্র সংক্রান্তি ছিল এক বৃহত্তর লোক উৎসব। এটি বসন্তের শেষ দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের আগের দিন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এ দিনটিকে অত্যন্ত পুণ্যদিন হিসেবে মানেন।
হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী, দিনটি মহবিষুব সংক্রান্তি নামে পরিচিত। এদিন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পিতৃপুরুষের তর্পন ও নদীতে পুণ্যস্নান করে থাকেন। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে কালের গর্ভে মিলিয়ে যাবে আরও একটি বছর। সমগ্র বাঙালি বরণ করে নেবে বাংলা নববর্ষকে। তাই চৈত্রের শেষ দিনে বৈশাখ বন্দনায় মেতে ওঠে বাঙালি। চৈত্র সংক্রান্তির প্রধান উৎসব চড়ক গাজন। চড়ক গাজনকে চড়ক পূজা, নীল বা গম্ভীরা পূজাও বলে। শিবভক্তরা একগ্রামের শিবতলা থেকে শোভাযাত্রা শুরু করে অন্যগ্রামের শিবতলা পর্যন্ত নিয়ে যান। শোভাযাত্রীদের মধ্যে একজন শিব ও একজন গৌরী এবং অন্য ভক্তরা নন্দি, ভৃঙ্গী, ভূত-প্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতি সেজে শিব-গৌরীর সঙ্গে নেচে চলেন। এসময় শিব সম্পর্কে নানারকম লৌকিক ছড়া আবৃত্তি করা হয়। চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় শূলফোঁড়া, বানফোঁড়া ও বড়শি গাঁথা অবস্থায় চড়কগাছে ঘোরা, আগুনে হাঁটা প্রভৃতি সব সাহসী ও কষ্টসাধ্য দৈহিক কলাকৌশল দেখানো হয়।

বৈশাখী মেলা
আগে বৈশাখের মূল আকর্ষণ ছিল বৈশাখী মেলা। এখনও নানা আঙ্গিকে উদযাপিত হলেও, হারিয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী অনেক খাবার, পিঠা, হরেক রকম পুতুল, পুতুলনাচ, লৌকিকতা, আচার ও দেশীয় জিনিস।
 
বৈসুক-সাংগ্রাই-বিজু উৎসব
বাংলাদেশে রয়েছে ৩২টি আদিবাসী গোষ্ঠী। পাহাড়ি সংস্কৃতি সমতলের তুলনায় আলাদা হলেও, তারা বেশ উদ্যম ও উৎসাহ নিয়েই বরণ করেন বাংলা নববর্ষ। তাদের বর্ষবরণের উৎসবগুলোর মধ্যে বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজু উল্লেখযোগ্য।
চৈত্রের শেষ দ্বিতীয় দিন ও বৈশাখের প্রথম দিন মিলে তিনদিন তারা এ উৎসব পালন করেন। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা আদিবাসীরা নিজ নিজ ধর্মের পূজাপাঠ ছাড়াও সেদিন ফুল কুড়োনো, জল উৎসব ও খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করেন।

হালখাতা
পুরোনো দিনে পয়লা বৈশাখের সঙ্গে আরও একটি বিষয় নিবিড়ভাবে জড়িত ছিল। তা হলো হালখাতা। বর্ষবরণের দিন গ্রামের প্রায় সব দোকানগুলোতে খোলা হতো ‘হালখাতা’। ব্যবসায়ীরা তাদের লেনদেন, বকেয়া, সবকিছুর হিসাব-নিকাশ লিখে রাখেন হালখাতায়। নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে ব্যবসায়ীরা নিজেদের নিয়মিত গ্রাহক, পৃষ্ঠপোষক ও শুভার্থীদের চিঠি দিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টিমুখ করান। তাতে থাকে রসগোল্লা, রাজভোগ, ক্ষীর, নিমকি আর কর্পূর মেশানো পানি।
এ দিনটিতে লেনদেনের চেয়ে সামাজিকতা ও সৌজন্য বিনিময় হতো বেশি। তবে সৌজন্যমূলক হলেও অনেকে গেল বছরের বকেয়াও শোধ করে দেন। নববর্ষের দিন দোকানে অতিথিদের হালখাতা এখনও যথারীতি খোলা হয়। তবে আনুষ্ঠানিকতা ও সৌজন্যবোধ কমে গেছে অনেকাংশেই।

মেজবান
এবার আসি চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ ভোজন উৎসব মেজবানের কথায়। মেজবান ফারসি শব্দ। এর অর্থ নিমন্ত্রণকর্তা। বাংলাদেশে মেজবানের উৎসব পালনের শুরু ঠিক কোন সময়ে তা জানা যায়নি। তবে বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকায় সুদীর্ঘকাল ধরে ঐতিহ্যবাহী এ অনুষ্ঠানটি পালিত হয়। প্রথা অনুযায়ী, মেজবানে মাটিতে চাটাই বিছিয়ে ও মাটির সানকিতে মেহমানদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। আকীকা, মৃত্যুবার্ষিকী বা নির্দিষ্ট উপলক্ষ ছাড়া বা কোনো শুভ ঘটনার জন্যও মেজবানের আয়োজন করা হয়।
মেজবানের মূল আকর্ষণ সাদা ভাত, গরুর মাংস, গরুর পায়ের হাড়ের ঝোল ও বুটের ডাল। বাড়িতে মাংস রান্নার সাধারণ প্রণালী থেকে মেজবানের মাংস রান্নার প্রণালী সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ব্যাঙ বিয়ে
প্রচণ্ড খরা। মাটি ফেটে চৌচির। চৈত্র পেরিয়ে বৈশাখের মাঝামাঝি। তবুও নেই বৃষ্টির দেখা। কৃষক সমাজে পড়ে গেছে হাহাকার। হাজার বছরের বাংলার মানুষের বিশ্বাস, এমন অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে ব্যাঙা-বেঙীর বিয়েই রক্ষা। ব্যাঙের বিয়েতে দু’টি ব্যাঙকে হলুদ মাখানো হয়। সাজানো হয় কুলা ও বরণ ডালা। কুলায় রাখা হয় পান, সুপারি, দূর্বাঘাস, মিষ্টিসহ বিয়ের উপকরণ। ব্যাঙ বর-কনের দু’টি পক্ষে বিভক্ত হয় গ্রামবাসী। চলে নাচগানের আয়োজনও। ‘আল্লাহ মেঘ দে... পানি দে... ছায়া দে রে তুই’ গানের মধ্য দিয়ে হয় ব্যাঙের বিয়ে। বিয়ের পর তাদের জলাশয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

মেঘরানি
বৃষ্টি কামনায় আরও একটি লোকাচার হলো মেঘরানি। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে পুকুর থেকে পানি নিয়ে এসে ঘরের টিনের চালে ছুড়ে দেওয়া হতো। সেই পানি গড়িয়ে উঠানে পড়ে মাটিতে কাদা হয়। সেই কাদা গায়ে মেখে সবাই সুর মিলিয়ে গাইতো, ‘মেঘারানি রে মেঘারানি, তোল ছাওয়ালে কতখানি, হাতখানি লম্বা, বড় নায়ের খাম্বা...’। এ গেল প্রাক ফসল উৎসব। ধান পাকার পর অর্থাৎ নতুন ধান কাটার পর কয়েকটি উৎসব পালন করা হতো। এর মধ্যে লক্ষ্মীর ছড়,  নবান্ন, পৌষ সংক্রান্তি অন্যতম।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৫
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।