ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

আমর ঘরপু দেখবা, আমর ব্যাডা-ভাতার নাই

শুভ্রনীল সাগর ও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪০ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৫
আমর ঘরপু দেখবা, আমর ব্যাডা-ভাতার নাই ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শ্রীমঙ্গল থেকে: হেলানো মিনারের মতো বাড়িটা ঝুঁকে রয়েছে। সম্বল বলতে ছনের ছাউনি আর বয়ঃবৃদ্ধ বাঁশের বেড়া।

  সামনে টাঙানো দড়িতে সারি সারি কাপড়। হঠাৎ বছর বারোর এক কিশোরী উদ্ভ্রান্তের মতো কাপড়গুলো সরাতে লাগলো, যাতে বাড়ি দেখতে দেখনেওয়ালার কোনো সমস্যা না হয়। তার দিকে চোখ পড়তেই, ‘আমি চা বাগানের শ্রমিক’।

ভাড়াউড়া চা বাগানের শ্রমিক বসতিতে ঢুকতে না ঢুকতেই এ দৃশ্য। ভাড়াউড়া যখন লেখা হলো, তখন শুরুতেই কিছু কথা বলে নেওয়া ভালো।

বাংলাদেশে মোট ৭টি টি ভ্যালি রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট বিভাগে রয়েছে ৬টি। এই ছয় ভ্যালিতে মোট চা বাগানের সংখ্যা ১৩৮টি। শুধু শ্রীমঙ্গলে রয়েছে ৩৮টি চা বাগান ও শ্রীমঙ্গলের পার্শ্ববর্তী এলাকাসহ চা বাগানের সংখ্যা হচ্ছে ৬০ টি। এজন্য শ্রীমঙ্গলকে চায়ের রাজধানীও বলা হয়।   শ্রীমঙ্গলের ৩৮টি চা বাগানের মধ্যে ১২টি ফিনলে কোম্পানির। এই ১২টির মধ্যে একটি হলো ভাড়াউড়া চা বাগান। আবাদি জমির পাশাপাশি বাগানের একটি অংশে শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা করে থাকে সব মালিক পক্ষ।  
 
যাই হোক, ছিলাম শ্রমিক বসতিতে। তারা কোথায়-কীভাবে থাকেন দেখতেই আসা। এর-ওর সঙ্গে টুকটাক কথাও এগুচ্ছে।   এর মধ্যে পাড়ায় রটে গেছে, ঢাকা থেকে কারা যেন এসেছে।   চোখে সানগ্লাস পরে খাতায় কী সব লিখে নিচ্ছে। তাদের খাতায় কোনোমতে নাম তুলতে পারলেই সব মুশকিলে আসান!

সবাই বুঝি খাতায় নাম তুলে ফেললো, কেবল আমারই উঠতে বাকি! অশেষ অসহায়ত্ব নিয়ে সামনে-পেছনে ঘুরছেন সন্ধ্যা রানি হাজরা (৬৫)।   শিরোনামটি তারই আকুতি।   অর্থ- আমার ঘর দেখুন, আমার ছেলেও নেই স্বামীও নেই। অবশ্য এখানকার ‘হাজরা’ সম্প্রদায় কথা বলে দেশোওয়ালি ভাষায়।   সেক্ষেত্রে শিরোনামের শুদ্ধ রূপটি হবে, ‘আমর ঘরপু দেখবা। আমর লাইকোও নাহা, স্বামীও নাহা’, হয়ত আমাদের বোঝাতেই এই আধা দেশোওয়ালি-আধা বাংলার আশ্রয়।  

সন্ধ্যা রানি ৫৬ বছর কাজ করেছেন চা বাগানে।   স্বামী মারা গেছেন আগেই। তিন ছেলের একজন ট্রেনে কাটা পড়ে ও আরেকজন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত। অন্যজনের ব্যাপারে বাসিন্দাদের ভাষ্য, ছেলেটি পাগল।   কাজেই থেকেও না থাকার মতো। যখন কর্মজীবী ছিলেন তখন ঘর পাননি। পরে বাগান কর্তপক্ষ বলেছিল, অবসরে গেলে ঘর পাবেন। সেইসঙ্গে তার জায়গায় যে আত্মীয় কাজ নেবেন তিনিও পাবেন ঘর।   কেউ অবসরে গেলে তার জায়গায় কোনো এক আত্মীয় কাজ পাওয়ার নিয়ম রয়েছে। ঘর-কাজ কোনোটি তো পাননি, উল্টে পেনশনের ৬০ হাজার টাকায় তোলা ইটের গাঁথুনি মাঝপথেই থেমে গেছে। হাতে কোনো টাকাও নেই, ওদিকে চা বাগান থেকে প্রাপ্য টিনও আসে না। এদিকে, দুইছেলের দুই স্ত্রীসহ ছেলেমেয়ে ও চালাবিহীন ইটের ঘর নিয়ে কার্যত তাদের বেহাল অবস্থা।  

ভাড়াউড়া বাগানে প্রায় ছয় হাজারের মতো মানুষের বাস।   এর মধ্যে সাড়ে সাতশ’ বর্তমানে বাগানে কর্মরত, বাকিরা তাদের পরিবার-পরিজন।   সংখ্যাগরিষ্ঠ সনাতন ধর্মাবলম্বী, কিছু সংখ্যক বিহারি মুসলিমও রয়েছেন। তালিকা করলে অভিযোগ শেষ হবে না।   কারও ঘর নেই, ঘর রয়েছে তো চাল-বেড়া নেই, চাল থাকলে পানি পড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি।   শকুন্তলা হাজরা, মানিকচাঁন রেখিয়াছন, লীলাবতী হাজরা, আলোমণি রেখিয়াছন...কার নাম বাদ দিয়ে কার নাম লিখি!

এই ঘর পাওয়া-না পাওয়ার বিষয়টি বুঝিয়ে দিলেন বিজয় হাজরা (৫২)। তিনি ২০০৯ থেকে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক।  

শোনা যাক তার মুখেই, একজন শ্রমিক দিনে ২৩ কেজি চা পাতা তুললে দিনপ্রতি ৬৯ টাকা মজুরির পাশাপাশি সপ্তাহে সাড়ে তিনকেজি আটা পেয়ে থাকেন। এর সঙ্গে শ্রমিকের থাকার বন্দোবস্ত মালিকপক্ষের করার নিয়ম।   চা কোম্পানি যখন জমি লিজ নেন, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বেশকিছু শর্ত দিয়ে দেওয়া হয়। শর্ত মানলেই তবে ২০ থেকে ২৫ বছরের জন্য জমি লিজ পান। শর্তেই উল্লেখ থাকে, জমির কত অংশ আবাদ হবে, কত অংশে শ্রমিকের আবাসন।   আবাসনের মধ্যে থাকবে বাড়ি, স্কুল, মন্দির-মসজিদ, টিউবওয়েল, স্যানিটারি প্রভৃতি।   কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ৯৬ ধারায়ও দেখা যায় একই বিষয়, প্রত্যেক চা বাগান মালিক চা বাগানে বসবাসরত প্রত্যেক শ্রমিক ও তার পরিবারের জন্য আবাসন সুবিধার ব্যবস্থা করবে।       

ফেরা যাক বিজয় হাজরার কথায়, এই অল্পশিক্ষিত মানুষগুলো অন্যসব তো ছেড়েই দিন, বোঝে শুধু ওই ঘরটুকুই।

নিয়ম অনুযায়ী, একজন শ্রমিক পাঁচ শতক জমির উপর ৩শ’ ৪০ বর্গফুটের বাড়ি পাওয়ার কথা। কিন্তু ম্যানেজাররা তাও কমিয়ে আড়াইশ’তে আনতে চাইছেন।   এতগুলো মানুষের জন্য মাত্র তিনটি টিউবওয়েল, তাও সরকারের পোঁতা।

কথার এক ফাঁকে সঙ্কোচ ঝেড়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, সাধারণত দেখা যায়, শ্রমিক নেতারা শ্রমিক হন না!

প্রশ্নের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তার চটজলদি উত্তর, এই ইউনিয়নে এমনটি হবার সুযোগই নেই! চা শ্রমিক ইউনিয়নের প্রত্যেক সদস্য শ্রমিকের মধ্য থেকে উঠে আসা। গঠনতন্ত্রে এরকমই নিয়ম। এটি পঞ্চায়েত কমিটির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।  

শ্রমিকদের বাড়ি সংক্রান্তসহ অন্য খুঁটিনাটি সমস্যাগুলো ম্যানেজার বরাবর পৌঁছে দিয়ে সেসবের সমাধান করাই পঞ্চায়েত কমিটির কাজ। তিনবছর পরপর শ্রমিকদের ভোটে কমিটি নির্বাচন হয়।   একই ব্যবস্থা অন্যসব চা বাগানেও।

কথা হলো ভাড়াউড়া বাগানের বর্তমান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি উজ্জ্বল হাজরার সঙ্গে। তার বসতির আবাসন ব্যবস্থার চাক্ষুষ দুরাবস্থার কথাও জানালো হলো তাকে।

বললেন, সবার সমস্যাগুলো তালিকা করে ম্যানেজার বরাবর জমা দিয়ে দিয়েছি। একে একে সব ঠিক হয়ে যাবে।  

অবস্থা পরিবর্তনের কথা জানালেন চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরীও (৫৫), আমাদের নির্বাচনী ইশতেহার ছিল, দৈনিক মজুরি ৬৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে একশ’ টাকায় উন্নীত করা। এ কমিটির মেয়াদ একবছর হতে চললো। সেটারই চুক্তি প্রস্তাব আমরা মালিক পক্ষের কাছে দিয়েছি। বর্তমানে বোনাস হিসেবে ২৬ দিনের মজুরি দেওয়া হয়। সেটা বাড়িয়ে ৩২ দিন করাসহ আরও শ্রমিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি থাকছে চুক্তিতে। আলাপ-আলোচনা চলছে; আশা করি, আগামী জুলাই মাসের মধ্যে একটি ফলাফল দাঁড়াবে।     

আবাসন সমস্যার বিষয়ে ভাড়াউড়া চা বাগানের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) গোলাম মোহাম্মদ শিবলির ভাষ্য, প্রত্যেকটি ঘর টিনশেডে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। গত দুই বছর ধরে এ কার্যক্রম চলছে। ২০১৬ সালের মধ্যে এটি শেষ হবে। তখন আর আবাসন সমস্যা থাকবে না।  

প্রত্যেক পক্ষই যে যার মতো শ্রমিকদের আশা দিয়ে চলেছেন।   কিন্তু তাদের একমাত্র আশা বোধহয় মিথিলা বাউরির এ কথাটি, সকাল-সন্ধ্যা চা বাগানে বৃষ্টিতে ভিজি, বাড়িতেও বৃষ্টিতে ভিজতে চাই না!

আগামী পর্বে থাকছে চা বাগানে শ্রমিকদের অবস্থা নিয়ে সরেজমিন 

বাংলাদেশ সময়: ১০২৯ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৫
এসএস/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।