“ঝরো-ঝরো ঝরো-ঝরো ঝরে রঙের ঝর্না/ আয় আয় আয় আয় সে রসের সুধায় হৃদয় ভর্-না/ সেই মুক্ত বন্যাধারায় ধারায় চিত্ত মৃত্যু-আবেশ হারায়,/ ও সেই রসের পরশ পেয়ে ধরা নিত্যনবীনবর্ণা”—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ গানটি যাদের জানা আছে, এখানে এলে অবলীলায় আপনার মনে বেজে উঠতে পারে গানটি। যেকেউ গাইতে শুরু করতে পারেন আপন মনেই।
ঝর্না শব্দটি শুনলে প্রথমেই আমাদের হিমছড়ি আর মাধবকুণ্ডের কথা মনে পড়ে। কিন্তু এ দুই ঝর্না ছাড়াও আমাদের দেশে আরো কিছু সুন্দর ঝর্না রয়েছে। একটু সাহসী হলে আর দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার ধৈর্য থাকলে যেকেউ উপভোগ করতে পারেন প্রকৃতির অকৃত্রিম—খৈয়াছড়া ঝর্নার সৌন্দর্য। কাচের মতো স্বচ্ছ পানি পাহাড়ের শরীর বেয়ে আছড়ে পড়ছে পাথরের গায়ে, গুঁড়ি গুঁড়ি জলকণা আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে তৈরি করছে কুয়াশার আভা। বুনোপাহাড়ের দেড়শ’ ফুট উপর থেকে গড়িয়ে পড়া স্রোতধারা কলকল শব্দে এগিয়ে যাচ্ছে পাথরের পর পাথর কেটে—সামনের দিকে তার গন্তব্যে।
চারপাশের গাছ গাছালি আর নাম না জানা হাজারও প্রজাতির লতাপাতা ও গুল্মে আচ্ছাদিত হয়ে আছে পাহাড়ের শরীর। স্রোতধারা সে লতাগুল্মকে ভেদ করে গড়িয়ে পড়ছে ভূমিতে। তৈরি করছে জলধারা। সে যে কী এক বুনো পরিবেশ—না দেখলে বিশ্বাস করানো কঠিন।
শ্রাবণের প্রবল বর্ষণে যখন পুরো জঙ্গল ফিরে পায় তার চিরসবুজ, হয়ে ওঠে সতেজ আর নবযৌবনা। খৈয়াছড়া ঝর্না তখন ফিরে পায় তার আদিরূপ, সৌন্দর্য। ঝর্নার সতেজতায় পাহাড়ী ঝিরিগুলো হয়ে উঠে কর্মচঞ্চল। সাঁই সাঁই করে ধেয়ে চলে ঝিরির জলরাশি। স্বচ্ছ জলস্রোত যখন পা গলিয়ে চলে যায়—জলের কোমল পরশে শরীর জুড়িয়ে যায় মুহূর্তেই।
অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্যটক, যারা চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করেন কেবল তাদের জন্যই রয়েছে এই ঝর্না দর্শনের সুযোগ। কেননা সরকারি তেমন কোনো উদ্যোগ না থাকায় এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রচার প্রচারণার অভাবে বাংলাদেশের অন্যতম এই জলপ্রপাত রয়ে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। শুধুমাত্র দৃষ্টিনন্দন ঝর্না নয়, পথের দু’পাশে বুনো গাছেরা দৃষ্টি কেড়ে নেবে আপনার। গাছের ফাঁকে ফাঁকে রঙিন ডানা মেলে দেয়া হাজারও প্রজাপতি। চশমা বানরের আনাগোনা ডুমুর গাছের শাখায়। গাছগাছালিতে ভরপুর এ বনাঞ্চল। পাহাড়ের ঝিরিপথে হেঁটে যেতে যেতে সুমধুর পাখির কলরব আপনার মনকে ভালোলাগার অনুভূতিতে ভরিয়ে দেবে। দূর থেকে কানে ভেসে আসবে পাখির কিঁচিরমিঁচির। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে একসময় আপনি পৌঁছে যাবেন কাঙ্ক্ষিত ঝর্নাধারার প্রথম ধাপে।
আটস্তরের এ ঝর্না দেখতে দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড় হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে। পাহাড়ের সবুজ রঙ আর ঝর্নার স্বচ্ছ জল মিশে মিশে একাকার হয়েছে মিরসরাইয়ের প্রাকৃতিক জলপ্রপাত খৈয়াছড়া ঝর্নায়। নান্দনিক তুলিতে আঁকা এ ছবি দেখে মুগ্ধ হচ্ছে আগত ভ্রমণপ্রেমীরা। খৈয়াছড়া এলাকার পাহাড়ে অবস্থান বলে এর নামকরণ হয়েছে খৈয়াছড়া ঝর্না। আট ধাপের এ ঝর্নায়—বেশিরভাগ পর্যটক প্রথম ধাপের সৌন্দর্য দেখেই মাতোয়ারা। উঁচু পাহাড়ে উঠে বাকি ধাপগুলোতে যাওয়া খানিকটা পরিশ্রমসাধ্য বলে অনেকেই ঝর্নার প্রথম ধাপের সৌন্দর্য দেখেই ফিরে আসেন। ঝর্নার শেষ ধাপে অনেক প্রশস্ত জায়গা জুড়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এটুকু বলা যায়, ঝর্নার শেষ ধাপ পর্যন্ত যারা আসবেন তারা বাংলাদেশের সেরা কোনো প্রাকৃতিক ঝর্না উপভোগ করবেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১০ সালে সরকার বারৈয়াঢালা ব্লক থেকে কুণ্ডেরহাট (বড়তাকিয়া) ব্লকের ২৯৩৩.৬১ হেক্টর পাহাড়কে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। খৈয়াছড়া ঝর্না জাতীয় উদ্যানের আওতাভুক্ত একটি দর্শনীয় স্থান। জাতীয় উদ্যানকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে কাজ করছে বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যানসহ ব্যবস্থাপনা কমিটি। ইতোমধ্যে খৈয়াছড়া ঝর্নাকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানা যায়।
আসার রাস্তা: মিরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নের বড়তাকিয়া বাজারের উত্তর পাশে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৪.২ কিলোমিটার পূর্বে ঝর্নার অবস্থান। এর মধ্যে ১ কিলোমিটার পথ গাড়িতে যাওয়ার পর বাকি পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে। বাঁশের সাঁকো, ধানক্ষেত, আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ, ছরা এবং চারটি সু-পাহাড় পেরিয়ে যেতে হবে প্রকৃতির বিস্ময় এই স্বচ্ছ জলরাশির কাছে।
থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা: খৈয়াছড়া ঝর্নাকে ঘিরে রাস্তা, রেস্টুরেন্ট, কটেজ ইত্যাদি নির্মাণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলছে ক্রমান্বয়ে। এখানে এসে খাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি হোটেল রেস্টুরেন্ট পাওয়া যাবে। খুব একটা অভিজাত না হলেও তৃপ্তি সহকারেই খাওয়া যাবে এসব হোটেলে।
থাকার জন্য পাবেন বেশ কয়েকটি কটেজ। কেউ যদি অগ্রীম কটেজ বুকিং দিতে চান, তাহলে যোগাযোগ করতে পারেন—জয়নাল আবেদীন কটেজের জন্য ০১৮৩৬-৭৭০১০৫ এবং ঝর্না কটেজের জন্য ০১৯৩০-৬৬২৭৬৭ নাম্বারে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১৫
টিকে