ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছে তাতে ক্ষতি নেই। মাথাব্যথাও নেই।
খবরটা দিতে গিয়ে শুরুতেই যেসব কথা বলা হয়েছে তা-ও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। সেখানে বলা হয়েছে তা সহজ বাংলায় তুলে ধরা যাক:
‘ কলা যা খাওয়ার এখনই তা খেয়েটেয়ে নিন। কারণ খাওয়ার মতো কলা পরে আর আপনার ভাগ্যে জুটবে না। কারণ কলা যা খাওয়ার তা আপনি/আপনারা খেয়েই নিয়েছেন। কেননা তারা (কলা) একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে—‘ Eat all the bananas you can now because soon, there won’t be any left. And it won’t be because you ate them all. It’ll be because they’ve gone … extinct.’
সত্যিই তো! হররের হরর-ই তো! পৃথিবী থেকে কলা নামের ফলটি চিরকালের মতো বিলুপ্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে –এমন খবর দুনিয়ার জন্য শুভ নয় মোটে। কলার মতো সর্বজনীন আর বিশ্বজনীন ফল তো আর একটিও নেই। সেই সঙ্গে কলার মতো খেতে-ঝামেলাহীন, পরিপাটি, পুষ্টিগুণে ভরপুর, সুস্বাদু, সস্তা আর সহজলভ্য ফল আর হয় না। তাছাড়া মানুষ আর তার নিকটাত্মীয় মানবেতর প্রাণির কাছে পরম আদরের, পরমপ্রিয় এই খাদ্যটি নিয়ে রসিকতাও কম হয় না। কখনও কখনও ‘কলা’ নামের শব্দটি অপাঙ্গে নেতিবাচক অর্থও বয়ে আনে---‘যাও গে, দেখি তুমি কোন কাঁচকলাটা করতে পারো আমার!’
আবার কাউকে ‘কলা দেখানো’র কথা বললেও বিপত্তি। আর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও তার ছোটবেলায় কলাভক্ষণের মধুর স্মৃতি তুলে ধরতে ভোলেননি :
‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি , তাহাতে কদলী দলি
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে
হাপুস-হুপুস শব্দ, চারিদিক নিস্তব্ধ
পিঁপিড়া কাদিঁয়া যায় পাতে...’
এতো গেল রবীন্দ্রনাথের কথা। তাছাড়া কলার সঙ্গে লাবণ্যের, সজীবতার যোগও আছে। ‘কলাবউ’ শব্দটিও এসেছে কলারই বৈগুণ্যে।
কবি জসীমউদ্দীনের কবিতায়ও আছে কদলীপত্রের চামর দোলানোর অনুপম বর্ণনা:
‘কলার পাতা দোলায় চামর/শিশির ধোয়ায় পা...’
বিশ্রে রাজনীতিতেও কলার উপস্থিতি জোরালো। ‘বানানা রিপাবলিক’ (Banana republic) নামের একটি শব্দবন্ধ চালু আছে রাজনীতিবিজ্ঞানে। পৃথিবীর পরনির্ভরশীল দুর্বল, অস্থিতিশীল এবং প্রায় সম্পদহীন দরিদ্র ও অন্য রাষ্ট্রের প্রভাবের কাছে নতজানু রাজ্যকে এককথায় ‘বানানা রিপাবলিক’ বলে ডাকা হয়। বানানা রিপাবলিকে মুষ্টিমেয় মানুষ লুটেপুটে খায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সম্পদ। এই সামাজিক বক্রনীতি যেন কলার আকৃতিরই সমার্থক। সোজা কথা, সোজা সরলভাবে কিছুই হয় না ‘বানানা রিপাবলিক’ বা ‘কদলী-রাষ্ট্রে’।
তাছাড়া ‘কলা’ দিয়ে সুকুমার শিল্পকেও বোঝানো হয়ে থাকে। যেমন, শিল্পকলা মানে আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট ।
যাকগে সেসব গৌরচন্দ্রিকা। এবার আসা যাক বিজ্ঞানীরা কলার সম্ভাব্য বিলুপ্তি নিয়ে কিকি বলেছেন আর এর পক্ষে কি কি কারণ তুলে ধরেছেন সে-প্রসঙ্গে।
বিশ্বব্যাপী (আভোক্যাডো্ স্বল্পতার খবরের পর)কলার আসন্ন সম্ভাব্য বিলুপ্তির আশঙ্কার এই খবরটাই খাদ্য সংক্রান্ত সবচেয়ে নেতিবাচক আর বিপর্যয়কর খবর বলে বর্ণনা করা করা হয়েছে এই নিউজ আইটেমটিতে। ‘PLOS Pathogens’ নিয়ে করা নতুন এক গবেষণার পর গবেষকরা দাবি করেছেন, ট্রপিক্যাল রেইস-৪ (Tropical Race 4) নামের একটি পরজীবীই (ভাইরাস) কলার বিলুপ্তির সূচনা করবে। একে ‘bananapocalypse’ বা ‘মহাকদলীপ্রলয়’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
পৃথিবীর খাদ্যশিল্পে কদলীবিপর্যয় কিন্তু এর আগেও একবার ঘটেছিল। তখন যে কলা পৃথিবীতে ফলতো তা ভাইরাসের কারণে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়। এখন আমরা যে কলা খাই সে কলা আর আগের কলা এক নয়। ১৯৬০ সালে ‘ট্রপিক্যাল রেইস’ নামের ভাইরাসজনিত ‘পানামা ডিজিজ’ (Panama disease) –এর কারণে ‘গ্রস মিচেল’ (Gros Michel) নামের কলার প্রজাতি চিরতরে বিলুপ্ত হয়---‘...Panama disease, caused by Tropical Race, essentially wiped out the entire crop of the Gros Michel.’
গ্রস মিচেল ভ্যারাইটির বিলুপ্তির পর ‘Cavendish banana’ নামের নতুন এক ভ্যারাইটির কলার জন্ম দেন বিজ্ঞানীরা। এখন মানুষ ক্যাভেন্ডিশ ভ্যারাইটির কলাই খাচ্ছে। এই প্রজাতিটি এতোদিন পানামা ডিজিজ ভাইরাস-সহনক্ষম হিসেবে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু এখন সেকথা আর খাটছে না। ভাইরাস এখন আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী। কলার শত্রু যে ক্ষতিকর ফাঙ্গাস সেটিকে আর কিছুতেই কাবু করা যাচ্ছে না। ফলে আপাতত কলাকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার আশা প্রায় নেই বলা চলে--- attempts to quarantine the fungus have proven completely insufficient.।
সারা দুনিয়ার কলার উপর মরণ কামড় বসাচ্ছে ‘ট্রপিক্যাল রেইস-৪’ নামের এই নতুন ধরনের ঘাতক ভাইরাস। ণের সারা দুনিয়ার ক্যাভেন্ডিশ ভ্যারাইটির ৮০ শতাংশ অচিরেই এই ভাইরাসের আক্রমণের কবলে পড়তে যাচ্ছে।
এমন মনখারাপের কথা না হয় আর না বাড়াই! এমন খারাপ খবর দিতে কাহাতক ভালেঅ লাগে বলুন! আপাতত চলুন দেখি আসলে কী হয়; কে জানে, আসন্ন মুসিবত থেকে কলাকে বাঁচানোর কৌশল কেরামতি বিজ্ঞানীরা বেরও করে ফেলতে পারেন। আসুন সে আশাতেই দিন গুনি তবে...
বাংলাদেশ সময়: ২৩০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৫
জেএম