ঢাকা: জামালপুর সদরের রণরামপুর গ্রামের নাজমা বেগম; ২৪ বছর আগে হারিয়েছেন স্বামী মতিউর রহমানকে। স্বামীহারা নাজমা তিন মাসের শিশু আকাশকে নিয়ে পড়েন অকূল পাথারে।
কিন্তু সংসারে ছোট বোন জরিনা খাতুন থাকায় দুই মেয়ে ও শিশু সন্তান আকাশের খোরাক জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে নাজমার বাবা-মাকে।
বাবা-মায়ের সংসারে ১০ বছর দারিদ্র্যের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে ২০০২ সালে ছোট বোন জরিনা ও সন্তান আকাশকে নিয়ে ঢাকার মিরপুরে আশ্রয় নেন নাজমা বেগম। বাবা হারা আকাশের বয়স তখন ১০ বছর। দুই বোন পোশাক কারখানায় কাজ খুঁজে পান। আকাশকে স্কুলের আঙিনায় পাঠাতে পারেননি নাজমা। যেখানে দুই বেলা অন্ন জোটে না সেখানে পড়ালেখা অনেকটা বিলাসিতার মতোই নাজমার কাছে।
নাজমা বেগম ও জরিনা পোশাক কারখানায় কাজ করে যে উপার্জন করেন তাতে কোনোরকমে সংসার চলছিল তাদের। বাসা ভাড়াসহ অন্যান্য খরচের পর কিছুই অবশিষ্ট থাকতো না।
২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে মিরপুর-২ নম্বরের নাসিমাবাগে ‘টি ট্রি’ নামে চায়ের দোকান দেন নাজমা ও জরিনা। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন পোশাক কারখানার চাকরি বাদ দিয়ে নাজমা ও জরিনা নিজেদের চায়ের দোকানেই কাজ করেন।
‘টি ট্রি’ বর্তমানে মিরপুরে একটি জনপ্রিয় চায়ের দোকান। প্রায় ২৫ পদের চা পাওয়া যায় এখানে। রকমারি চায়ের মধ্যে বিউটি, হেলথ, মাসাল্লা, ইয়োগাহার্ট ও ব্রাজিলিয়ান তাপিওকা চা প্রতি কাপ ৩০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
ককটেল ২০, মাল্টা ১০, অরেঞ্জ ১৫, লেমন ১০, স্পাইসি ১০, কফি টি ১০ ও গুঁড় চা ১০ টাকা দরে বিক্রি হয় ‘টি ট্রি’তে। এছাড়াও আছে নানা পদের জুস ও কফি। কফির মধ্যে রেগুলার, আইস, পিয়ানাট, ব্লাক, চায়না মুন ও চকলেট কফি মন কাড়ে সবার।
দোকানে চা বিক্রি করেন নাজমা ও জরিনা। তবে সমস্ত কিছু তদারকি করেন নাজমার একমাত্র সন্তান আকাশ। বর্তমানে টি ট্রির একটি শাখাও খোলা হয়েছে। দুটি দোকানে প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার টাকার চা বিক্রি হয়।
‘টি ট্রি’ প্রসঙ্গে আকাশ বাংলানিউজকে বলেন, তিন মাস বয়সে বাবাকে হারিয়েছি। মা অনেক কষ্ট করে বড় করেছেন। ঢাকার অনেক পোশাক কারখানায় মা (নাজমা) কাজ করেছেন। এতে করে কোনো রকমে সংসার চলতো। এরপর মায়ের মাথায় চায়ের দোকানের চিন্তা এলো। তখন চিন্তা করলাম চা মানে শুধু দুধ চা ও রঙ চা নয়। চা এখন শখের বিষয়। এর পরে নানা পদের চায়ের কথা মাথায় আসে। আল্লাহর রহমতে মাত্র দুই বছরের মাথায় আরেকটি শাখা খুলেছি। এখন মা ও খালা (জরিনা) চায়ের দোকানেই কাজ করে। তাদের আর পোশাক কারখানায় যেতে হয় না। আমি চায়ের উপকরণ কিনে বেড়াই। আগে কোনো রকম টিকে ছিলাম এখন বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখি। ইচ্ছা আছে সারা ঢাকা শহরে আরও শাখা খোলার।
ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে সবাই ছুটে আসেন ‘টি ট্রি’ স্টলে। চা পিপাসুরা একদিকে যেমন পেয়ে থাকেন অনাবিল তৃপ্তি অন্যদিকে নাজমা-জরিনাও পেয়েছেন আশ্রয় ও সুখের ঠিকানা। তবে ‘টি ট্রি’ স্টলে চা পিপাসুদের অর্ডার দেওয়ার পরও ২০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। কারণ সব সময় এখানে ভিড় লেগেই থাকে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর রাত ১০টা পর্যন্ত জমে ওঠে নাজমার ‘টি ট্রি’।
বাংলাদেশ সময়: ০১০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০১৫
এমআইএস/এমজেএফ